হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকালে চারিদিকে ঘন সবুজের শুভ্রতা, শিশির বিন্দু আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ। ঠান্ডা মৃদু বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস সঙ্গে ভোরের প্রথম আলোয় দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে এবারও খালি চোখে দেখা মিলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা অপরুপ সৌন্দর্য।
পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই দেশের গন্ডি থেকে দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের দ্বিতীয় উচ্চতম ও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছবির মতো ভেসে উঠা শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য ছাড়াও সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে কার্শিয়ং, দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল। দেশের সীমানা পেরিয়ে যাদের এ পর্বত দেখার সুযোগ হয় না, তারা ছুটে আসেন এ দৃশ্য উপভোগ করতে।
বিজ্ঞাপন
বিশেষ করে হেমন্ত ও শীতের সময়ে একমাত্র পঞ্চগড় থেকে খালি চোখে দেখা যায় হিমালয় পর্বতমালার দ্বিতীয় উচ্চতম ও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার। মাউন্ট এভারেস্ট ও কে টু’র পরে এর স্থান। পর্বতের কিছু অংশ ভারতের সিকিম ও কিছু অংশ নেপালে অবস্থিত। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেখা গেলেও এবছর খানিকটা আকাশ পরিষ্কার ও মেঘ মুক্ত থাকায় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেখা মিলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ সৌন্দর্যের। পঞ্চগড়ের প্রায় সব জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা মনোমুগ্ধকর অপরুপ দৃশ্য খালি চোখে দেখা গেলেও সব চেয়ে ভালো দেখা যায় সীমান্ত নদী মহানন্দা তীরের ঐতিহাসিক তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো পিকনিক কর্ণার থেকে।
সূর্যের আলোর সঙ্গে কখনও শুভ্র, গোলাপী আবারও কখনও লাল রঙ নিয়ে হাজির হয় বরফ আচ্ছাদিত এই পর্বত চূড়া। পাহাড়টির সৌন্দর্য্যের উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর ও বিকেল বেলা। তখন পর্বত চূড়াটি পোড়ামাটির রঙ নেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসলে তখন রঙ হয় সাদা। যেন আকাশের বুকে এক খণ্ড বরফ। যারা দেশের সীমানা পেরিয়ে যাদের এই পর্বতচূড়া দেখার সুযোগ মিলে না। তারা শীতের এসময় ছুটে আসেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। এবং পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই উপভোগ করেন এমন অপরুপ সৌন্দর্য। সর্বোচ্চ এই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখতে অনেকেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিল পয়েন্টে আবার কেউ কেউ সরাসরি নেপালে। তবে যাদের পাসপোর্ট ও ভিসা করে দার্জিলিং ও নেপালে যাওয়ার সুযোগ হয় না, তারা কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈসর্গিক রূপ অবলোকন করতে ছুটে আসেন পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী উপজেলার তেঁতুলিয়ায়। কারণ এই দেশের একমাত্র কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ সৌন্দর্য পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর অক্টোবর শেষে ও নভেম্বর মাসের শুরুতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও এবছর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেখা মিলছে এবং বিগত বছরের তুলানায় আকাশ মেঘমুক্ত থাকায় অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দেখতে ছুটে আসতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুরা। অনেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপ দেখার জন্য রাত থেকে অপেক্ষা করে বসে থাকেন৷ পর্যটকদের থাকার জন্য জন্য রয়েছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ও উপজেলা পরিষদের বেরং কমপ্লেক্সে এবং বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল। দেশের সব বিনোদন কেন্দ্রে যেতে, দেখতে বা ঢুকতে টাকা লাগলেও বা টিকেট কাটতে হলেও তেঁতুলিয়ায় বিনা পয়সায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা যায়।
এদিকে শীত পড়ার আগেই পরিষ্কারভাবে হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দেয়ায় অনেকেই সেই সৌন্দর্য ও দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করেছেন। মূলত মেঘ মুক্ত আকাশ থাকায় পর্বতটি দেখা দিয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
তেঁতুলিয়ার জেলার পরিষদের ডাকবাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্য আরও বেশি নজর কাড়ে পর্যটকদের। এছাড়া তেঁতুলিয়ার পিকনিক কর্ণারে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা যা ছোট বড় সবার নজর কাড়ে।
আরও পড়ুন
জনসমাগমে ভরপুর কক্সবাজার সৈকত, দুদিনে এলো আড়াই লাখ পর্যটক
বগুড়া থেকে আসা এনামুল হক বলেন, আমি গতকাল খবর জানতে পারি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। পরে বন্ধুরাসহ তেঁতুলিয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছি। তবে এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাকবাংলো পিকনিক কর্নারে মহানন্দা নদীর তীর থেকে পর্বতটি দেখতে পেয়েছি। আমাদের এ যাত্রা সফল হয়েছে।
একই কথা জানান আবির হোসেন। তিনি বলেন, বছরের শুরু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার জন্য তেঁতুলিয়া আসার পরিকল্পনা ছিল। তবে আজ দেখা না গেলে আমাদের রাত থাকার প্লান ছিল। যেহেতু দেখা হয়েছে, তাই অন্য স্থানগুলো ঘুরে আবার বাড়ি ফিরে যাব।
ঢাকা থেকে আসা বুলবুল আক্তার বলেন, আমাদের আজ (বুধবার) সকালে পৌঁছাতে একটু দেরি হওয়ায় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অন্য পর্যটক ও স্থানীয়রা জানালেন যে সকালে দেখা গেছে। যেহেতু আজ দেখা হয়নি, তাই আগামীকাল দেখার জন্য তেঁতুলিয়ায় থাকব।
চট্টগ্রাম থেকে ঘুরতে আসা ইমতিয়াজ ও জয় বলেন, আজকে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমরা কিছুক্ষণের জন্য দেখতে পেরেছি। আমাকে তেঁতুলিয়ার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও প্রকৃতি বেশ ভালো লেগেছে। সঙ্গে তেঁতুলিয়ার মানুষ অনেক আন্তরিক হওয়ায় বিষয়টি আরও ভালো লেগেছে।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা আতিয়ান নাহার বলেন, আমরা এর আগেও তেঁতুলিয়ায় বেড়াতে এসেছি। কিন্তু এবার তিনজন বান্ধবী মিলে তেঁতুলিয়ায় আবারও বেড়াতে এসেছি। আজকে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবি দৃশ্য দেখে বেশ আনন্দিত।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বী বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায়। আর এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। যেহেতু একদিকে তেঁতুলিয়া পর্যটন এলাকা অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মৌসুম। তাই পর্যটকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে আমরা নজর রেখেছি। তারা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যাপারে নজর রাখছি। আবাসিক হোটেল থেকে শুরু পরিবহনের লোকজনের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে, যাতে পর্যটকদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তারা দেখেন। আর থানা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন মিলে আমরা তৎপর রয়েছি। পর্যটকরা কোনো সমস্যায় পড়লে আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস