পবিত্র কাবাঘর পৃথিবীর সবচেয়ে বরকতময় স্থান। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়াত ও বরকতময়। (সুরা আলে ইমরান: ৯৬)
বরকতময় এই স্থানে গিয়ে দোয়া করার সুযোগ সাধারণত কেউ হাতছাড়া করেন না। এছাড়াও মদিনা মুনাওয়ারার বিভিন্ন স্থানে দোয়া করেন হাজিরা। কেননা প্রথমত হজের মৌসুমটাই হলো দোয়া কবুলের সেরা মৌসুম। তাছাড়া পবিত্র কাবাঘর ও মসজিদে নববি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। এই দুই পবিত্র স্থানের বিভিন্ন স্থানে ও হজ আদায়ের সময়ে আল্লাহ তাআলা হাজিদের দোয়া কবুল করে থাকেন। যেকোনো দোয়া করতে পারেন। তবে, কোরআন হাদিসে বর্ণিত দোয়া করাই শ্রেয়। এখানে মক্কা-মদিনায় দোয়া কবুলের বিশেষ কিছু স্থান উল্লেখ করা হলো।
বিজ্ঞাপন
১. কাবাঘর দেখে দোয়া
কাবা শরিফে দৃষ্টি পড়ার সময় দোয়া করা সুন্নত। হাদিসে এসেছে, পবিত্র কাবার দিকে তাকিয়ে দোয়া করলে দোয়া কবুল হয়। হজরত ইবনে জুরাইজ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (স.) কাবা শরিফকে দেখে এই দোয়া পড়েছিলেন হে আল্লাহ! আপনি এই ঘরের সম্মান, মর্যাদা ও মহিমা বৃদ্ধি করে দিন এবং যে ব্যক্তি এই ঘরের হজ ও ওমরা করে তারও সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিন।’ (মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার: ৯৭৯৬)
আরও পড়ুন: কাবা বায়তুল্লাহ: আল্লাহর কুদরতি নিদর্শন
২. মুলতাজাম দোয়া কবুলের স্থান
মুলতাজাম দোয়া কবুলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে কাবা শরিফের দরজা পর্যন্ত জায়গাটুকুকে মুলতাজাম বলে। এই স্থানে নবীজি দোয়া করতেন। হজরত আমর ইবনে শুয়াইব (রা.) বর্ণনা করেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সঙ্গে হজে ছিলাম। তিনি হাজরে আসওয়াদ ও কাবা শরিফের দরজার মাঝের দেওয়ালের নিকট দাঁড়ালেন। নিজের বুক, দুই হাত ও কপাল লাগিয়ে রাখলেন এবং বললেন, রাসুল (স.)-কে আমি এভাবেই করতে দেখেছি। (ইবনে মাজা: ২৯৬২)
৩. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দোয়া
সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয় আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দুই পাহাড়ের মাঝে সাঈ করা হাজিদের জন্য ওয়াজিব। উভয় পাহাড়ই দোয়া করা ও দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম স্থান।
৪. আরাফার মাঠে দোয়া
আরাফার মাঠে দোয়া সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আরাফাতের দিনের দোয়াই শ্রেষ্ঠ দোয়া। দোয়া-জিকির হিসেবে সর্বোত্তম হলো ওই দোয়া, যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ করেছেন। তা হলো— لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শায়ইন ক্বাদির।’ অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই, রাজত্ব একমাত্র তারই, সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র তারই জন্য, আর তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান।’ (জামে তিরমিজি: ৩৫৮৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩৭৭৮)
আরও পড়ুন: আরাফার দিনের উত্তম দোয়া যা পূর্ববর্তী নবীরাও পড়েছেন
৫. মুজদালিফায় দোয়া
মুজদালিফা দোয়া কবুলের স্থান। এখানে দোয়া করা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যখন আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশআরুল হারামের কাছে পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে।’ (সুরা বাকারা: ১৯৮)
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) মুজদালিফায় অবস্থানকালে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ডাকো। তোমাদের দোয়া কবুলের কিছু স্থানে আছ। তবে জেনে রেখ! আল্লাহ তাআলা গাফেল অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।’ (তিরমিজি: ৩৪৭৯)
৬. কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া
দোয়া কবুলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সময় হচ্ছে, জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে দোয়া করা। কঙ্কর নিক্ষেপের পর জামারার স্থান থেকে সামান্য সরে গিয়ে প্রাণ খুলে দোয়া করা উচিত। হাদিসে এসেছে, ‘ইবনে উমর (রা.) জামারায় সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন এবং প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবির দিলেন। এরপর কেবলার দিকে মুখ করে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করলেন। ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমি এভাবে রাসুলকে (স.) করতে দেখেছি।’ (বুখারি: ১৭৫২)
আরও পড়ুন: মিনাতে শয়তানের ফাঁদ, জেনে রাখুন
৭. বিদায়ী তাওয়াফের পর দোয়া
হজের সব কর্ম শেষ করে দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফ শেষে আপনি মুলতাজামের কাছে চলে যাবেন। মুলতাজামে চেহারা, বুক, দুই বাহু ও দুই হাত রেখে দোয়া করবেন। এটিই আপনার শেষ সুযোগ। আল্লাহর কাছে যা খুশি আপনি চাইতে পারেন। হাদিসে এসেছে, ‘ইবনে উমর (রা.) হাজরে আসওয়াদ ও কাবা শরিফের দরজার মাঝের দেওয়ালের নিকট দাঁড়ালেন। নিজের বুক, দুই হাত ও কপাল লাগিয়ে রাখলেন এবং বললেন- রাসুলকে (স.) আমি এভাবেই করতে দেখেছি।’ (ইবনে মাজা: ২৯৬২)
৮. জমজমের পানি পানের সময় দোয়া
জমজমের পানি পান করার সময় আপনার যা খুশি আল্লাহর কাছে চাইবেন। জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)
জমজমের পানি পান করার সময় একটি দোয়া পাঠ করা সুন্নত। দোয়াটি হলো— اَللّٰهُمَّ اِنِّيْ اَسْئَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَّرِزْقًا وَّاسِعًا وَّشِفَاءً مِّنْ كُلِّ دَاءٍ উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিআও ওয়া রিজকান ওয়াসিয়াও ওয়া শিফাআম মিন কুল্লি দা-ইন।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণকর জ্ঞান, প্রশস্ত রিজিক এবং যাবতীয় রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করছি।’ (দারা কুতনি: ৪৬৬)
আরও পড়ুন: জমজমের পানি পানের পদ্ধতি ও দোয়া
৯. হাজরে আসওয়াদের নিকট দোয়া
হাজরে আসওয়াদ দোয়া করার অন্যতম স্থান। ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) হাজরে আসওয়াদকে দুই ঠোঁটে চুমু খেয়ে লম্বা সময় ধরে কান্নাকাটি করলেন। এরপর তাকিয়ে দেখলেন উমর (রা.)-ও কান্নাকাটি করছেন। বললেন, উমর! এটা অশ্রু ঝরার স্থান!’ ( ইবনে মাজাহ: ২৯৪৫)
১০. রুকনে ইয়ামানির নিকট দোয়া
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানি ইস্তিলাম করে এরপর দোয়া করে তার দোয়া কবুল করা হয়।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ৪৪৪০)
১১. রিয়াজুল জান্নাতে দোয়া
হজ-ওমরা করতে যাওয়া প্রত্যেকেই ছুটে যান মসজিদে নববিতে। রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ পড়ে তারা জীবনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। ইয়াজিদ ইবনে আবু উবাইদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি সালামা বিন আকওয়ার সঙ্গে আসতাম এবং মুসহাফের নিকটবর্তী পিলারের কাছে নামাজ পড়তাম। অর্থাৎ রিয়াজুল জান্নাতে। আমি বললাম, হে আবু মুসলিম, আপনাকে দেখি এ পিলারের কাছে নামাজ পড়তে বেশি আগ্রহী? তিনি বলেন, আমি নবী (স.)-কে এ পিলারের কাছে নামাজ পড়তে আগ্রহী দেখেছি। (বুখারি: ৫০২; মুসলিম: ৫০৯)
আরও পড়ুন: রিয়াজুল জান্নাহ: পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাত
১২. মাকামে ইবরাহিমে দোয়া
‘মাকামে ইবরাহিম’ পবিত্র কাবা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত জান্নাতি পাথর। এখানে দোয়া করলে আল্লাহ তাআলা কবুল করেন, তাই এই স্থানকে দোয়া কবুলের স্থান বলা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং দোয়া করছিল,) ‘হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ (সুরা বাকারা: ১২৭)
উপরোল্লিখিত স্থানসমূহ ব্যতীত পুরো হারাম শরিফেও দোয়া কবুল হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। এছাড়া রাসুল (স.)-এর জন্মস্থান, হজরত খাদিজা (রা.)-এর বাড়ি, গারে হেরা, গারে সাওর, দুই উস্তুয়ানা, দারে আরকাম, মেহরাবে নবী, আসহাবুস সুফফা ইত্যাদি স্থানও দোয়া কবুল হওয়ার স্থানসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
পবিত্র হজের প্রধান উদ্দেশ্য হলো— আল্লাহর মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া। সময় ও জবান ঠিকমতো কাজে লাগিয়ে হাজীদের জন্য রয়েছে তা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহ তাআলা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

