শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

ইসলামে ‘সালাম’ ছাড়া অন্য অভিবাদন নয়

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামে ‘সালাম’ ছাড়া অন্য অভিবাদন নয়

সালাম ইসলামে সর্বোত্তম ও একমাত্র অভিবাদন। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা জাগ্রত করে সালাম। দূর করে মানব-মনের অহঙ্কার, হিংসা বিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা। ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় হয়। সালাম দেওয়া-নেওয়া নবী-রাসুলদের সুন্নত। আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম সালামের শিক্ষা দেন। তিনি সালাম দিলে ফেরেশতারাও উত্তর দেন। রাসুল (সা.)-কে মিরাজের রাতে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সালাম দিয়েছেন এভাবে—‘আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ও পরিপূর্ণ এ অভিবাদনরীতি বলবৎ থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।

জান্নাতেও সালামের প্রচলন থাকবে। মুসলিমরা জান্নাতে যাওয়ার সময় ফেরেশতারা বলবেন, ‘তোমাদের প্রতি সালাম’, তোমরা সুখী হও’ (সুরা জুমার: ৭৩)। এক জান্নাতি অপর জান্নাতিকে সালাম দেবে। ‘সেখানে তাদের অভিবাদন হবে সালাম’ (সুরা ইউনুস: ১০)। মহান আল্লাহ তাআলাও জান্নাতিদের সালাম দেবেন। ‘সালাম, পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সম্ভাষণ।’ (সুরা ইয়াসিন: ৫৮)

সালাম আরবি শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে শান্তি, প্রশান্তি, কল্যাণ, দোয়া, শুভকামনা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)–কে সৃষ্টি করে বলেন, যাও ফেরেশতাদের সালাম দাও এবং তারা তোমার সালামের কী উত্তর দেয়, মন দিয়ে শোনো। এটিই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালাম। সে অনুযায়ী হজরত আদম (আ.) গিয়ে ফেরেশতাদের বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’, অর্থ ‘আপনাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ ফেরেশতারা উত্তরে বলেন, ‘আসলামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’, অর্থ ‘আপনার ওপর শান্তি এবং আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।’ (মিশকাত: ৪৬২৮)।

মুসলিম ভাইকে সালাম দেওয়ার নিগূঢ় অর্থ দাঁড়ায়—আপনি আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং সর্বাবস্থায় আমি আপনার কল্যাণকামী। সালাম একটি সম্মানজনক, অভ্যর্থনামূলক, অভিনন্দনজ্ঞাপক, পরিপূর্ণ ইসলামি অভিবাদন। ‘সালাম’ আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের মধ্যে অন্যতম। (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ২৪)। জান্নাতেরও একটি নাম ‘সালাম’ (আনআম: ১২৭)

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, নবীজি (স.) মদিনায় পদার্পণ করে সর্বপ্রথম যে কথা বলেছেন, তা হলো—‘হে লোক সকল, তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, অভুক্তকে আহার করাও, গভীর রাতে সালাত আদায় করো’ (তিরমিজি-২৪৮৫)।

‘আমি কি তোমাদের এমন একটা কথা বলব, যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করো’ (মুসলিম: ৫৪)। অন্য হাদিসে এসেছে—এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন কাজ উত্তম? নবীজি (স.) বললেন, ‘খানা খাওয়াবে আর চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেবে’ (বুখারি: ১২)।


বিজ্ঞাপন


সালাম না দেয়া কৃপণতা। এই কৃপণতা থেকে বাঁচতে হলেও বেশি বেশি সালামের প্রচলন করা দরকার। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাম দিতে কার্পণ্য করে সে সব চেয়ে বড় কৃপণ। যে ব্যক্তি দোয়া করার ব্যাপারে অক্ষম, সে সবচেয়ে অক্ষম’ (আল আদাবুল মুফরাদ হা-১০৪২)।

এছাড়াও 'একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হক আছে। তন্মধ্যে একটি হলো- সাক্ষাতে সালাম বিনিময়। বাকি ৫টি হলো—

দাওয়াত দিলে গ্রহণ করা

উপদেশ চাইলে উপদেশ দেওয়া

হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা

অসুস্থ হলে সাক্ষাৎ করে খোঁজ খবর নেওয়া এবং

মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত হওয়া । ' (মুসলিম: ৪০২৩)

বড়-ছোট, অল্প-অধিক, পদচারী-উপবিষ্ট—সবাই সবাইকে সালাম দিতে পারে। ‘রাসুল (স.) ছোটদেরও সালাম দিয়েছেন’(মুসলিম: ২১৬৮)। তবে, মুস্তাহাব হলো- “ছোট বড়কে সালাম দেবে; আরোহী পদচারীকে; পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দেবে; এটাই ইসলামের রীতি। (বুখারি: ৬২৩২)

যতবার দেখা হবে, ততবার সালাম দেওয়া যায়’। (আবুদাউদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা তোমাদের কোনো ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করো, তাকে সালাম দাও; যদি তোমাদের উভয়ের মধ্যে কোনো গাছ কিংবা পাথর বা দেয়াল আড়াল করে তারপর আবার দেখা হয় তাহলে আবারও সালাম দাও।’ হজরত আবু উমামাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট উত্তম ব্যক্তি সে, যে মানুষকে আগে সালাম দেয়।’ (আবুদাউদ)।

সালাম পৌঁছানোর নিয়মও আছে ইসলামে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত—

নবীজি (স.) বললেন, হে আয়েশা জিবরাইল তোমাকে সালাম দিচ্ছেন। আয়েশা (রা.) উত্তরে বললেন, তার প্রতিও সালাম, রহমত, বরকত বর্ষিত হোক (বুখারি:৩২১৭)।

সালাম দেওয়া সুন্নত আর উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমাদের সালাম দেওয়া হবে, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে অথবা জবাবে তাই দেবে।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৮৬)।

চিঠি বা যেকোনো মাধ্যমে সালাম দিলেও তার উত্তর দেওয়া আবশ্যক। দূতের মাধ্যমে সালাম পাঠালে মুস্তাহাব হলো দূতকেও সালাম দেওয়া এবং এভাবে বলা, ‘ওয়া আলাইকা ওয়া আলাইহিস সালাম।’ কেউ কারো মাধ্যমে  সালাম পাঠালে, অনেকেই উত্তর না জানার কারণে সালামের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকে। অথচ উত্তর দেওয়া তার জন্য আবশ্যক ছিল। এক সাহাবি বলেন, আমার আব্বা আমাকে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট পাঠালেন এবং বললেন, তাঁকে সালাম প্রদান কর। আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট গিয়ে বললাম, আমার আব্বা আপনাকে সালাম বলেছেন, তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন- ‘আলাইকা ওয়া আলা আবিকাস-সালাম’ অর্থাৎ, তোমার এবং তোমার পিতার প্রতি সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)’

বধির ব্যক্তিদের সালাম দেওয়ার সময় মুখে বলার সঙ্গে সঙ্গে হাতে ইশারা করতে হবে।

অমুসলিমদের সালাম দেওয়া প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে,

لا تبدءوا اليهود ولا النصارى بالسلام ‘তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রথমে সালাম দেবে না।’ (মুসলিম ২১৬৭)

মুসলমানের কোনো বৈঠকে অমুসলিম থাকলে ‘আসসালামু আলা মানিত্তাবাআল হুদা’ বলতে বলেছেনে কেউ কেউ। তবে, উক্ত বাক্যটি রাসুল (স.) কেবল অমুসলিম শাসক ও নেতাদের নিকট চিঠি লেখার সময় ব্যবহার করতেন (বুখারী হা/৭, মিশকাত হা/৩৯২৬)।

আর ‘আহলে কিতাবগণ তোমাদের সালাম দিলে, তার উত্তরে তোমরা শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’বলবে।’ (বুখারি: ৬২৫৮’ মুসলিম: ২১৬৭)

অমুসলিমদের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সৌজন্য প্রদর্শনস্বরূপ তার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বা অন্য কোনোভাবে যেমন হাতের দ্বারা ইশারা করে কুশলবিনিময় করার অবকাশ রয়েছে। তাকে দাদা আদাবও বলা যেতে পরে। তবে কোনোভাবেই নমস্কার বা নমস্তে বলা যাবে না। (রহীমীয়া, ৬/১২৬  কিফায়াতুল মুফতী ৯/১০৬)

ফতোয়ায়ে শামীতে আছে  

وفى رد المحتار ( ويسلم) المسلم ( على أهل الذمة ) لو له حاجة إليه وإلا كره هو الصحيح –فصل فى البيع.

যদি কোনো প্রয়োজন বশত হয়,তাহলে কাফেরকে সালাম দেওয়া যাবে। অন্যথায় তাদেরকে সালাম জানানো মাকরুহ।

বৈঠকের আগে-পরে সালাম দেওয়া সুন্নত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মজলিশে উপস্থিত হলে যেন সালাম দেয়। মজলিশ থেকে চলে যাওয়ার সময়ও যেন সালাম দেয়।’ (আবু দাউদ হা-৫২০৮)

হাদিস অনুযায়ী, বিশেষ পরিস্থিতিতে সালাম দেওয়া মাকরুহ এবং জবাব দেওয়া জরুরি নয়। যেমন: নামাজরত ব্যক্তি, কোরআন শরিফ তিলাওয়াতকারী, জিকিরকারী, হাদিস পাঠদানকারী, খুতবাদানকারী এবং শ্রবণকারী, ফিকহ নিয়ে আলোচনাকারী, বিচারকাজে ব্যস্ত বিচারক, আজানরত মুয়াজ্জিন, ইকামত দানকারী যখন ইকামত দেন, পাঠদানে ব্যস্ত শিক্ষক ও প্রাকৃতিক কাজে লিপ্ত বা বিবস্ত্রকে সালাম দেওয়ার প্রয়োজন নেই। খেয়াল রাখতে হবে সালাম দিতে গিয়ে যেন কারো ঘুম ভেঙে না যায়।

অন্যের গৃহে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—

ইহজীবন সুন্দর করার ক্ষেত্রে সালামের বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বেশি বেশি সালামের প্রচার প্রসার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর