বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা গোটা দেশের মানুষের অন্তরকে নাড়া দিয়েছে এর একটি মতিঝিলের শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর নৃশংস হামলা। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে অবস্থান হেফাজতের নেতাকর্মীদের সরাতে তৎকালীন স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট খেতাব পাওয়া সরকার রীতিমতো উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। তারা এটাকে নিজেদের অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল। এজন্য কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই রাতে।
মধ্যরাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিরীহ আলেম-ওলামা ও মাদরাসা ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় শেখ হাসিনার পুলিশ, র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি। বিদ্যুৎহীন ঘুটঘুটে অন্ধকারে মুহুর্মুহু গুলি, কাঁদানো গ্যাস, গ্রেনেড ছুড়তে থাকে ফ্যাসিস্ট সরকারের বেপরোয়া বাহিনীগুলো।
বিজ্ঞাপন
সেই ঘটনায় দেশের আলেম-ওলামা ও দীনদার মানুষের মধ্যে যখন চলছিল শোকের কান্না তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের কণ্ঠে ছিল দম্ভোক্তি। সেই রাতে শাপলায় কোনো লাশ পড়েনি বলেও দাবি করছিলেন তাদের কেউ কেউ। উল্টো এই পরিস্থিতির জন্য হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। শাপলার বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করেন খোদ তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে দলের নেতারাও একই সুরে কথা বলেন।
শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে বলেন, সেদিন (৫ মে, ২০১৩) শাপলা চত্বরে গোলগুলি বা সেরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ তাদের (হেফাজত) পাশে দাঁড়িয়েছে। সমাবেশে আগত বাচ্চাদের বাস ও লঞ্চে তুলে দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তারা (হেফাজত) গায়ে রঙ মেখে পড়ে ছিল। পুলিশ ডাক দিলে উঠে দৌড় মারছে। দেখা গেল লাশ দৌড় মারল।
শেখ হাসিনার এমন হাস্যকর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। হৃদয়ে আঘাত পান লাখো মাদরাসার ছাত্র। সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। এছাড়া তিনি বলেন, হেফাজত পরিকল্পিতভাবে রাজধানীতে এ তাণ্ডব চালিয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, এতে জামায়াত ও বিএনপির কর্মীরা সংযুক্ত ছিল। হেফাজতের মোড়কে তারা এটি করেছে। ভবিষ্যতে হেফাজতের মোড়কে আর কেউ যেন এ তাণ্ডব চালাতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিজ্ঞাপন
কটাক্ষ করে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরও বলেন, যারা মুসলমানের পবিত্র কোরআনের হেফাজত করে না, তারা ইসলামের কী হেফাজত করবে?
হেফাজতকে দমনের বিষয়ে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের লোকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এদের নজরদারিতে রাখতে হবে। তবে হেফাজতের মোড়কে অন্য কেউ যুক্ত হয়ে যাতে কোনো ধরনের অরাজকতা চালাতে না পারে, সে লক্ষ্যে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলেন, হেফাজতে ইসলাম বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে চলে গেছে। হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞ কার্যক্রম বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের অংশ।
তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘জঙ্গিবাদী তৎপরতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তারা রাজধানীকে অচল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সরকার বরদাশত করবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ার করে দেন।
ওই দিনের হামলার আগে সৈয়দ আশরাফ বলেন, সমাবেশ শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা না ছাড়লে যা যা করা দরকার সরকার তার সবই করবে। হেফাজতে ইসলামকে ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা’ আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের দুর্বল ভাববেন না। আপনাদের শায়েস্তা করতে আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। হেফাজতের নেতাকর্মীদের কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আপনারা কাপুরুষ। আপনারা ‘৭১-এ পরাজিত হয়েছেন। ‘৭১-এ আপনারা খুন, ধর্ষণ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করে তখন বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হেফাজতিরা মধ্যরাতে পিটুনি খেয়ে সুবহানাল্লাহ বলে পালিয়েছে।’
হেফাজতের ওপর দোষ চাপিয়ে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মেয়েরা ইজ্জত নিয়ে কাজ করতে পারবে। আর সেদিন হেফাজতের নামে যারা ঢাকায় এসেছে, তারা নারীদের ঘরে বন্দি করার দাবি নিয়ে এসেছে।
তৎকালীন পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ হেফাজত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেন, হেফাজত যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা কোনো ধর্মীয় সংগঠন করতে পারে না। বরং এটি রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করে না। তাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে তাদের সংগ্রাম কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আজকে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, যখন আরও কয়েকটি বিচারের রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে, যখন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতাকে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন হেফাজতরা তাণ্ডব চালিয়েছে।
আমু বলেন, হেফাজতের তাণ্ডব স্মরণ করিয়ে দেয় ‘৭১-এর কথা। হেফাজতের বিরোধিতা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে নয়, তাদের বিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধ ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। হেফাজতে ইসলামের মূল সংগ্রাম নারীদের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, হেফাজত যখন পবিত্র কোরআন শরিফে আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করছিল তখন কী কারণে খালেদা জিয়া ঢাকাবাসীকে হেফাজতে ইসলামের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন? কী এমন শক্তির বলে তিনি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন? জনগণ তা চানতে চায়।
নির্বাচিত সরকারকে এতটা দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই জানিয়ে হানিফ বলেন, আসলে তিনি (খালেদা জিয়া) সবার সঙ্গে কথা বলে সুপরিকল্পিতভাবে আলটিমেটাম দিয়েছেন। তারা চেয়েছিলেন সবাই এক সঙ্গে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে।
আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ব্যঙ্গ করে বলেন, আগে বলতাম হেফাজতে ইসলাম জামায়াত। এখন বলব হেফাজতে ইসলাম খালেদা জিয়া। হেফাজতে ইসলাম নিজেরাই নিজেদের হেফাজত করতে পারেনি।
দেশজুড়ে ভয়ংকর সেই পরিস্থিতিতে পরিবার যখন নিহতের লাশ গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছে, হতাহতদের বিষয়ে মুখ খুলতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তখন ওই সময়ের ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ ব্যাঙ্গাত্মক করে বলেন, শাপলা চত্বরে গভীর রাতের অভিযানে এত এত লোক মারা গেলে তাদের মা-বাবা ও আত্মীয়রা কোথায়? তিনি বলেন, হেফাজতের পরিকল্পনা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুট ও সচিবালয়ে আক্রমণ করা। রাতে যদি তাদের শাপলা চত্বর থেকে সরানো না হতো, তাহলে তারা তা-ই করত।
এমআর/জেবি