- সাদা কাফনে লাশ সাজিয়ে চার হাসপাতাল দৌড়ঝাঁপ
- মৃত্যুর পর শুরু হয় পুলিশের হয়রানি
- বুক হৃদপিণ্ড কিডনিতে ছিল হাজার খানেক ছড়রা গুলি
- ওসি বদল হলেই থানায় টাকা দিতে হতো
মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু (৪৮) যশোর সদরের খড়কি ওয়াপদা মসজিদের সানি ইমাম হিসেবে চাকরি করতেন। ২০১৩ সালের ৪ মে সকালে যশোর থেকে রওনা হয়ে রাতে ঢাকায় ঢোকেন। এর পরদিন ৫ মে বিকেলে গাবতলী থেকে পায়ে হেটে রওনা হন মতিঝিল শাপলা চত্বরের সমাবেশস্থলে। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। এরই মাঝে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঝামেলা। সেই সময়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের আসরের নামাজের জন্য হেটে আসছিলেন তিনি ও নড়াইলের মাহবুব নামে আরেক ব্যক্তি। তারা মসজিদে ঢোকার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। এরই ফাঁকে কালো পোশাকধারী এক ব্যক্তি এসে তাকে পেছন দিক থেকে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন। এরপর তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, আমরা তো তোকেই খুঁজতেছি। এসময় নান্নু প্রাণে বাঁচতে তার পা ধরে হাত করজোড় করেন। তাকে জানান, নান্নুর দুটি মাছুম ছোট বাচ্চা রয়েছে। তাকে মারলেও যেন প্রাণে জীবিত রাখেন। এ কথা শোনার পর সেই ব্যক্তি তার ডান পা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে দেন। পরে তার বুকে রাইফেল ঠেকিয়ে ছড়রা গুলি করেন। সেই গুলি বিধে ঢুকে যায় নান্নুর কলিজা ও হৃদপিণ্ড পর্যন্ত। যার সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার খানেক। ফলে তাকে আর বাঁচানো যায়নি। এরপর তার লাশ দাফন, পরিবারকে হেনস্তাসহ নানা ঘটনা ঘটতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগী নান্নুর গ্রামের বাড়ি যশোরের সদর উপজেলার খড়কি মোল্লাবাড়ি গ্রামের মৃত শহীদুল ইসলামের ছেলে। তিনি মৃত্যুর সময় তিন মেয়ে দুই ছেলেকে রেখে যান, যা তার স্ত্রীর জন্য বড় বোঝা হয়ে যায়। এরপরও জীবন সংগ্রামে থেমে থাকেননি সেই নারী। ১২ বছরে তাদের এই দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে আপনজনরাও নানা নির্যাতন করেছেন।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় নিহত নান্নুর মেজো মেয়ে সুমাইয়া বলছিল, আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি।
সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে তিনি জানান, তার বাবা যখন গাবতলী থেকে পায়ে হেটে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছিলেন তখন তার সাথে ফোনে তাদের কথা হয়। তখন তাকে মেয়ে ও স্ত্রী মানাও করেন। কিন্তু নান্নু একটা কথাই বলেছেন, আমি আল্লাহর রাস্তায় তার খুশির জন্য বের হয়েছি। আমাকে শফি হুজুরের সাথে দেখা করে তবেই ফিরতে হবে। পরে এশার আজানের সময় টিভিতে সংবাদে লাইভ চলছিল। তাতে সেখানে তার মেয়ে তাকে দেখতে পান। তিনি একটি দোকান আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই তার মেয়ের ফোনে বাবা গুলিতে আহত হওয়ার খবর আসে।
গুলি খেয়ে পড়ে ছিলেন নান্নু!
বিজ্ঞাপন
নান্নু যখন গুলি খেয়ে পড়ে ছিলেন, তখন পাশেই ছিলেন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক শাহীন। এরপর নান্নুর নাম্বার থেকে শাহীন তার মেয়েকে কল করে জানান, এখানে একটি লাশ পড়ে আছে। এ কথা শুনে নান্নুর মেয়ে জানান, এটা তার বাবার নাম্বার এবং তিনি এই নম্বর পেলেন কোথায়। তখন শাহিন জানান, তার বাবা গুলি খেয়ে পড়ে আছেন। শাহীন প্রথম দিকে নান্নুকে মৃত ভেবেছিল। এরপর তিনি নড়েচড়ে উঠলে শাহীন জানান, তিনি বেঁচে আছেন।
সুমাইয়া জানান, এ কথা শুনে শাহীনকে অনুরোধ করেন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। নান্নুকে বাঁচানোর জন্য কাঁধে তুলে হাসপাতালে ছোটেন। পরে শাহীন বহুকষ্টে নান্নুকে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু সেই শাহীনকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ তাকে গুলি করলে তার পায়েও ছড়রা গুলি লাগে। তিনিও আহত হন।
বুকে ঠেকিয়ে গুলি করা হয়
নান্নুর সঙ্গে মতিঝিলে আসা মাদরাসার ছাত্রদের একটি জায়গায় নিরাপদে রেখে নামাজের জন্য বায়তুল মোকাররমে হেটে আসছিলেন। পথে তাকে পেছন দিক থেকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে হামলা করে। এসময় তার সঙ্গে থাকা মাহবুব নামে এক ব্যক্তিকেও গুলি করেন সেই কালো পোশাকধারী ব্যক্তি। এরপর ডান পা পিটিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে বুকের ডান পাশে রাইফেল ঠেকিয়ে ছড়রা গুলি করা হয়। এতে তার বুকের ভেতর প্রায় হাজার খানেক গুলি ঢুকে যায়। ফলে অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল যে, আইসিইউতে নিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি। পরে অবশ্য তাকে কীভাবে গুলি করেছিল কালো পোশাকধারী সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। তা তিনি তার দুই মেয়েকে হাসপাতালে বেডে শুয়ে শুয়ে বলেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় নান্নুকে চারদিন পর গ্রামে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।
লাশ গ্রামে নিতেও পথে পথে পুলিশের বাধা!
নান্নুর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, চিকিৎসক বলেছিল উনি বাঁচবেন না। আপনারা বাসায় নিয়ে যান। পরে পথেই তার মৃত্যু হয়। এই মৃত ব্যক্তিকেও গ্রামে নেওয়ার সময় পথে পথে ছিল পুলিশি বাধা, ভয় ও আতঙ্ক। তার মেয়ে বলছিলেন, তারা যখন মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হন তখন থেকে পুলিশের দুটি গাড়ি তাদের ফলো করতে থাকে। এক পর্যায়ে পাটুরিয়া ঘাটে ফেরীকে নজরদারিতে নেয় পুলিশ। পরে তারা চালাকি করে ফেরীর চালককে ম্যানেজ করে অন্য ঘাটে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নেমে যায়। কিন্তু তার আগেই খবর আসে নান্নুর গ্রামের বাড়ি পুলিশ ও র্যাব ঘিরে রেখেছে। পরে তড়িঘড়ি করে তাকে দাফনে বাধ্য করে প্রশাসন। লোকজন হলে আন্দোলন হতে পারে, এমন ভয়ে সেদিন অবরোধ ডাকে আওয়ামী লীগ। তবুও লাখো মুসল্লি তার জানাজায় শরিক হন।
সুমাইয়া বলেন, বাবার লাশ নিয়ে যেতেও পথে ছিল আরেক বাধা। পুলিশের ভয়ে তো আমরা পালাচ্ছি। কিন্তু খুলনার দিকে আবার রাস্তায় ঝড় শুরু হয়। তাতে গাছ পড়ে আটকে যায় আমাদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। পরে চালক সেটি কেটে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলেন।
পরিবারকে নিদারুণ হয়রানি ও নজরদারি
নান্নুর মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নেমে আসে বিভিন্ন রকম জুলুম ও হয়রানি। প্রতিমাসে পুলিশ আসত এবং খোঁজখবর করত। এলাকার আওয়ামী লীগের লোকজনকে কেউ দেখতে আসলে তাদেরকে নানান ভাবে হেনস্তা করতেন। ফোন, মানিব্যাগ, টাকা কেড়ে নিতেন যুবলীগের ডিকো নামে এক যুবক। তার নেতৃত্বে পরিবারটিকে নানান ভাবে হয়রানি করা হতো।
আর এই হয়রানির নেপথ্যে অন্যতম ছিলেন শাহিন চাকলাদার। তার কথাতেই ডিকো নামের সেই যুবক সারাক্ষণ পরিবারটিকে নজরদারিতে রাখতেন। এছাড়াও এলাকায় প্রচার করা হয়েছিল, পরিবারটি রাষ্ট্রদ্রোহী। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে নান্নু। আরও বলা হতো, তাদের সাথে তোমরা কেউ মিশবেনা। এমনকি তার সন্তানদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সময় নানান ভাবে হেনস্তা করা হয়েছে।
ওসি বদল হলে থানায় টাকা দিতে হতো!
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শুধু আওয়ামী লীগের হয়রানি নয়, যতবার ওসি বদল হয়েছে ৫ আগস্টের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত —প্রতিবার থানাকে ম্যানেজ করতে মোটা অংকের টাকা দিতে হয়েছে। পরিবারটির আতঙ্ক ছিল, তাদের নামে নতুন কোনো মামলা দেওয়া হয় কিনা।
সুমাইয়া বলেন, আমরা প্রতি ওসি বদল হলেই সেকেন্ড অফিসারকে দিয়ে তাকে টাকা দেওয়াতাম, যাতে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট না হয়।
সাদা কাফনে লাশ সাজিয়ে চার হাসপাতাল দৌড়ঝাঁপ
শাহীন নামের প্রাইভেটকার চালক নান্নুকে উদ্ধার করে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তার খবর পেয়ে ঢাকায় থাকা এক ভাগিনাকে বিষয়টি অবগত করে তার পরিবার। সেখানে রাত চারটা পর্যন্ত ছিলেনও শাহীন। পরে নান্নুর দূর সম্পর্কের সেই ভাগিনা পৌঁছেন। তখন হাসপাতালের ভেতরে কাঁদানে গ্যাস মেরে পুলিশ অভিভাবকদের বের করে দিচ্ছিল। এছাড়াও হেফাজতের ঘটনায় কোন আহত ব্যক্তিকে সেই হাসপাতালে থাকতে দিচ্ছে না পুলিশ।
এক পর্যায়ে চিকিৎসকরা জানান, তাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি জীবিত থাকলে তাকে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না। ফলে নান্নুর সেই ভাগিনা তাকে সাদা কাফনে একটি স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে লাশ সাজিয়ে হাসপাতালের বাহিরে নেন। পরে তাকে নিয়ে তার সেই ভাগিনা ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী, ইবনে সিনা হাসপাতালসহ চার হাসপাতালে ছুটেছেন। কিন্তু তার অবস্থায় এতটাই ভয়াবহ ছিল কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি নিতে চায়নি। শেষমেশ মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে খুব গোপনে চলে তার চিকিৎসা। এরপর সেই হাসপাতালে চার দিন চিকিৎসায় জীবিত ছিলেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, ভালো না রাখা সম্ভব না।
খোঁজ নেয়নি কেউ!
নান্নুর পরিবার জানিয়েছে, তার মৃত্যুর পর তিন শবে বরাতে হেফাজতে ইসলামের লোকজন সরাসরি গিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসেন। এরপর আরও দুইবার তার ছেলে মেয়েদের জন্য কাপড়, সেমাই, চিনি কিনে দেন তারা। এখন আর কোনো নেতা সাহায্যকারীকে খুঁজে পান না পরিবারটি। ফলে নিদারুণ অভাব-অনটন নিয়ে প্রতিদিন কাটে। এর মাঝে নান্নু তার বাবার থেকে যে সম্পদ পেয়েছিল, তার একটি অংশ তার বড় ভাই টাকা ধার দিয়ে পরিশোধ করতে না পারার অজুহাতে দখল করে রেখেছে। তার পরিবারের এমনও দিন গেছে, অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন তারা। কথিত আপনজনরাও তাদের খোঁজ নেয়নি।
জানাজায় মাইক ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি!
মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু এলাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন। তার জানাজায় লাখো মুসল্লির ঢল নামতে পারে —এই আশঙ্কাত সেই জানাজায় কোনো ধরনের মাইক ব্যবহার করতে দেয়নি পুলিশ। তবুও হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় শরিক হয়েছিল, যা ছিল সেই এলাকার স্মরণকালের বড় জানাজা।
এমআইকে/এমএইচটি