ঠিক এক যুগ আগে ২০১৩ সালের এই দিনে (৫ মে) রাজধানীর শাপলা চত্বরে বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান নিয়েছিলেন আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। নাস্তিক ব্লগারদের বিচারসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল কওমি মাদরাসাভিত্তিক আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সে দিন ছিল তাদের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি।
সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরা এসে রাজধানীর ছয়টি প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছিলেন। একপর্যায়ে হেফাজতের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেয়, একটি সমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। আর এর জন্য তারা বেছে নেন শাপলা চত্বরকে, যেখানে ঠিক এক মাস আগে (৬ এপ্রিল) লংমার্চ কর্মসূচি শেষে সমাবেশ করেছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মূলত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘিরে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের দলীয় লোকজন ছিলেন মারমুখী। বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। শাপলা চত্বরে সমাবেশের ব্যাপারে হেফাজত নেতারা প্রশাসনের সঙ্গে দেন দরবার করছিলেন। এক পর্যায়ে অনুমতিও মেলে। তবে ডিএমপির শর্ত ছিল শুধু মোনাজাত করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হবে আয়োজন।
মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহও দেখতে পান দায়িত্বরত সাংবাদিকরা।
তবে দিনভর গুলিস্তান, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী লালবাগ মাদরাসায় অবস্থান করছিলেন। কথা ছিল, তিনি এসে দোয়া করে অবস্থান কর্মসূচি সমাপ্তি ঘোষণা করবেন। তিনি মতিঝিলে আসার জন্য রওয়ানাও দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল যে, তিনি আর আসতে পারেননি। এরই মধ্যে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এদিকে এভাবে কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করলে নানা স্থানে নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে হেফাজত নেতারা রাতে সেখানেই অবস্থানের ঘোষণা দেন।
এই পরিস্থিতিতে সরকার ছিল চরম আতঙ্কে। তাদের ধারণা ছিল, কোনো মতে হেফাজত নেতাকর্মীরা শাপলা চত্বরে রাতভর অবস্থান নিয়ে থাকলে সকালে তাদের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যুক্ত হবে। এতে সরকারের পতন হয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে সরকার মরণকামড় দেয়। যেকোনো মূল্যে হেফাজতকে সেখান থেকে সরাতে হবে সেই সিদ্ধান্ত হয় সরকারের উচ্চ মহলে। সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে গভীর রাতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।
বিজ্ঞাপন
তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি সন্ধ্যায় একটি সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতকে কড়া হুঁশিয়ারি দেন। না হলে কঠিন মূল্য দিতে হবে বলে জানান। তখনই আঁচ করা যাচ্ছিল রাতে ভয়াবহ কিছু হবে।
পুরো অপারেশনের নেতৃত্ব দেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। তিনি তখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার। পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ এবং বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।
গভীর রাতে সাঁড়াশি অভিযান, ভয়াবহ নৃশংসতা
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে যখন রাতে হেফাজত নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। চারদিক ছেয়ে যায় অন্ধকারে। তখন হেফাজতের লোকদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য প্রস্তুত হন পল্টন, ফকিরাপুল ও দিলকুশা এলাকায়। হেফাজতের লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য খোলা রাখা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক গণমাধ্যমকর্মীর ভাষ্যমতে, রাত দেড়টার দিকে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা শাপলা চত্বরের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন। প্রথমে হাতমাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে সাড়া না পাওয়ায় মূল অভিযান শুরু করতে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মূল অভিযান শুরু রাত পৌনে তিনটায়।
তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি সন্ধ্যায় একটি সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতকে কড়া হুঁশিয়ারি দেন। না হলে কঠিন মূল্য দিতে হবে বলে জানান। তখনই আঁচ করা যাচ্ছিল রাতে ভয়াবহ কিছু হবে।
গণমাধ্যমকর্মীরা জানান, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ—তিন বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকেন। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ১০ মিনিট ধরে চলে এ পরিস্থিতি। এরই মধ্যে একপর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করেন শাপলা চত্বরের দিকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তোপখানা মোড় থেকে এগোনো শুরু করার পর ১০ মিনিটেই পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে। ট্রাকের ওপর ভ্রাম্যমাণ মঞ্চও খালি হয়েছিল মুহূর্তেই।
মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের ওপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো চারটি মৃতদেহও দেখতে পান দায়িত্বরত সাংবাদিকরা।
এদিকে অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী–সমর্থক মতিঝিল এলাকায় সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়াদের বের করে এনে এলাকা ছাড়া করা হয়। ভোর চারটার সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থেমে থেমে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আশপাশের ভবনগুলোতে তল্লাশি চালায়।
ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। অভিযানে শাপলা চত্বর খালি করার পর বলেছিলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে চলে গেছে।’
রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিভিন্ন দল। তবে পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা যান। আর দিনের সহিংসতায় নিহত চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চের কাছে একটি ভ্যানে। ৫ মে দিনের সহিংসতা এবং পরদিন ৬ মে দুই দিনে সারাদেশে সহিংসতায় ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে পুলিশের গোপন রিপোর্টে ১৯১ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ২০১৩ সালের ১০ জুন প্রথম অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ৬১ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মে মাসে অস্বাভাবিকভাবে ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়, যা প্রতি মাসের গড় দাফনের চেয়ে চারগুণ বেশি।
বিইউ/জেবি