সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫, ঢাকা

লাশ হস্তান্তরে স্ত্রীকে হেফাজত নেতাদের আসামি করার শর্ত দেয় পুলিশ

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৫ মে ২০২৫, ০১:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

লাশ হস্তান্তরে স্ত্রীকে হেফাজত নেতাদের আসামি করার শর্ত দেয় পুলিশ

নজরুল ইসলাম ২০১৩ সালে ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গিয়ে গুরুতর আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্যুর পর লাশ দিতে গড়িমসি শুরু করে তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন। শুধু তাই নয়, শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় মামলায় হেফাজত নেতাদের আসামি করতে হবে। আর এই মামলার বাদী হবেন খোদ তার স্ত্রী। না হলে লাশ কোনোভাবে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে না। হেফাজতকর্মী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পরদিন তার লাশ নিয়ে এমন কাণ্ড ঘটায় মতিঝিল থানা পুলিশ। যদিও শেষমেষ তার স্ত্রীর দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

shapla_chattar_5_may_2
২০১৩ সালের ৫ রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ঘুমন্ত নেতাকর্মী ও অনুসারীদের ওপর হামলে পড়ে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত 

নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। কিন্তু তিনি গাবতলী এলাকায় থাকতেন এবং সেখানেই একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তখন নজরুলের বিয়ের মাত্র আড়াই বছর। রাসুল ও আল্লাহকে ভালোবাসার টানে ২০১৩ সালে ৫ মে অন্যদের সঙ্গে তিনিও এসেছিলেন শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি।

Screenshot_2025-05-05_132746
শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পুলিশি অভিযানের পরের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় নজরুলের মাথার বামপাশ

৫ মে রাত তখন ১২টা। হেফাজতের নেতাকর্মীরা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে আশপাশের ভবনগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছিলেন। সেখানে সোনালী ব্যাংক ভবনের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন নজরুলও। কিন্তু ওই সময় গোলাগুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু হলে অন্যরা পালিয়ে যান। কিন্তু তিনি তখনও ঘুমিয়ে ছিলেন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন—

শাপলায় কী ঘটেছিল সেই রাতে, কতটা ভয়াবহ ছিল অভিযান

জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় রাইফেলের বেয়নেটের সামনের অংশ দিয়ে খুঁচিয়ে গুরুতর আহত করেন পুলিশের এক সদস্য। পরে তাকে তার সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আট দিন পর তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় তার স্ত্রী পারুল ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, তার সঙ্গে রাত ১২টার সময় কথা হয়েছিল। কিন্তু এরপরই মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায়। ফোনে নজরুল তাকে বলেছিলেন- ‘বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে। বড় হুজুর না বলা পর্যন্ত আমরা এই ভবন থেকে বের হব না। কারণ আমরা তো নবীর জন্য এখানে এসেছি’।

হেফাজত নেতাদের আসামি করতে হবে, শর্ত ছিল পুলিশের

নজরুল ইসলামের লাশ বুঝিয়ে দেওয়ার আগে শর্ত জুড়ে দেয় পুলিশ। তার স্ত্রীকে একটি লিখিত কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে। যাতে লেখা থাকবে হেফাজতের কর্মীরা তার স্বামীকে হত্যা করেছেন। আর সেই কাগজের সূত্র ধরে পুলিশ মামলার যাবতীয় আয়োজন করবে। বাদী হবে তার স্ত্রী পারুল। পুলিশ বারবার নিহতের স্ত্রী পারুলকে ডাকছিল এবং চাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু সেদিন তিনি পুলিশের এমন অন্যায় আবদারে কোনোভাবে সাড়া দেননি।

shapla_chattar_5_may
হেফাজতের সমাবেশ পণ্ড করতে পুলিশের অ্যাকশন। ছবি: সংগৃহীত

পারুল বলেন, “তারা আমাকে কোনোভাবে স্বামীর লাশ দেবে না। শর্ত দিলো হেফাজতের নেতাদের মামলায় আসামি করতে হবে। তখন আমি বললাম, আমি যেটা দেখিনি কেন সেটা মামলায় উল্লেখ করব। আমি তো জানি না, আমার স্বামীকে পুলিশ নাকি হেফাজতের কর্মীরা হত্যা করেছে। আর আপনারা যদি লাশ না দেন তবুও আমি এটাতে স্বাক্ষর করতে পারব না। তখন ওসিসহ সেখানে থাকা দারোগারা আমার সঙ্গে চরম খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তারা বলতে থাকে, অনেকে স্বামীর লাশ নিতে কত শর্ত মানে আর আপনি এই ছোট শর্তটাও মানছেন না।  ফলে আমাকে শেষমেষ মামলার কাগজে লিখতে হয়েছে, আমার স্বামী হেফাজতের সমাবেশের স্থল দিয়ে হেঁটে আসার পথে গুরুতর আহত হন। পরে তার মৃত্যু হয়।”

পারুল জানান, এর জন্য থানার ওসি ও এসআই তাকে নানাভাবে হেনস্থা করেছে।

মৃত্যুর ২৫ ঘণ্টা পর দেওয়া হয় লাশ

নজরুল ইসলাম ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আট দিন পর ভোর ৫টায় মারা যান। তখন তার লাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল পরিবার। কিন্তু বাধ সাধে পুলিশ। তারা ঢামেক থেকে লাশটি কোনোভাবেই নিতে দেবে না। লাশটি দেওয়া হয় মতিঝিল থানায়। মৃত্যুর শুরু থেকে ২৫ ঘণ্টা পর পুলিশ পরিবারকে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

তার স্ত্রী বলছিলেন, “মারা যাওয়ার পর শুরু হয় ঝামেলা। পুলিশ তার লাশ থানায় নিয়ে আটকে রাখে। আমি একবার পল্টন থানায় যাই, আরেকবার মতিঝিল। এভাবে শেষশেষ জানলাম মতিঝিল থানায় লাশ রাখা হয়েছে। পরে আমাকে পুলিশ ডাকে এবং নানা শর্ত ও প্রস্তুাব দেয়। কিন্তু আমি তাদের প্রস্তুাবে রাজি হইনি। এ কারণে যেখানে অল্প সময় লাগার কথা সেখানে ২৫ ঘণ্টা পর লাশ বুঝিয়ে দেন তারা। সেটাওতে নানা শর্ত ছিল।”

পুলিশের ভয়ে মোবাইলে সিম বদলে ফেলেন নিহতের স্ত্রী

স্বামীকে কবরে দাফনের পর নেমে আসে আরেক বিপদ। মতিঝিল থানা পুলিশের পক্ষ থেকে তার ফোনে বারবার কল করা হতো। ভয়ে তিনি ফোন ধরতেন না। নিহতের স্ত্রী পারুল বলেন, আমাকে এত ফোন দেয়া হতো যে আমি বিরক্ত। তারা ফোন করেই বাড়ির ঠিকানা, গ্রামের ঠিকানা চাইতো। ফলে এক সময় আমি সেই মোবাইল ফোন নম্বরটি পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। 

হেফাজত কর্মীদের চিকিৎসা না দিতে নির্দেশ মন্ত্রীর

নজরুলের স্ত্রী জানান, তার স্বামী ঢামেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে খবর শুনে তিনি সেখানে চলে যান। গিয়ে শুনতে পান সেখানে আহতদের কোনো চিকিৎসা দেওয়া হবে না। কারণ মন্ত্রী এসে বলে গেছেন, এখানে কোনো হেফাজতের অসুস্থ কর্মী বা ৫ মের ঘটনায় আহত থাকলে এমন কেউ চিকিৎসা পাবে না। এজন্য সব চিকিৎসককে নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। এরপরও মানবিক দায়বোধ থেকে অনেক চিকিৎসক সেদিন অসুস্থদের চিকিৎসা দিয়েছিল। 
এমআইকে/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর