শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ক্যাম্পে বিদ্যুৎ অপচয়ের হিড়িক, বিল যাচ্ছে বিহারি নেতাদের পকেটে

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২২, ১০:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ক্যাম্পে বিদ্যুৎ অপচয়ের হিড়িক, বিল যাচ্ছে বিহারি নেতাদের পকেটে

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটে পড়েছে দেশ। সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে কৃচ্ছ্বতা সাধনের আহ্বান জানানো হচ্ছে বারবার। কিন্তু আটকে পড়া পাকিস্তানি খ্যাত বিহারি ক্যাম্পগুলোতে উল্টো চলছে বিদ্যুৎ অপচয়ের হিড়িক। একটি লাইট ও একটি ফ্যান ব্যবহারের কথা থাকলেও তারা হিটার-ইস্ত্রি থেকে শুরু করে বিদ্যুতের সব কাজই করছে। যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও বিদ্যুৎ খরচ করতে দেখা গেছে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের।

মূলত তারা বিদ্যুৎ বিল আদায় করেন না। ছয় বছরে তাদের কাছে বকেয়া পড়েছে ২২৮ কোটি টাকা। সরকার বিদ্যুৎ বিল না পেলেও ক্যাম্পের নেতারা নানা বাহানায় নিয়মিত বিল নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবাঙালি ক্যাম্প রয়েছে ছয়টি। মিরপুরে ৩৯টি। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে শরণার্থী হিসেবে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছেন তারা। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি পরিবার বিনামূল্যে একটি লাইট ও একটি ফ্যানের বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। তবে ২০১৬ সাল থেকে খাতা-কলমে এই সুবিধা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি সুযোগের অপব্যবহার।

গত ছয় বছরে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের ক্যাম্পগুলো থেকে এক পয়সাও বিল পরিশোধ করা হয়নি বিদ্যুৎ বিপণন সংস্থাগুলোকে। বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ২২৮ কোটি টাকা।

বিপণন সংস্থাগুলোর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের ৪৫টি ক্যাম্পে প্রতি মাসে প্রায় তিন কোটি টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়।

তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব ক্যাম্পে বসবাসকারী ও নিয়ম মেনে বিদ্যুৎ খরচ করলে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ বিল আসার কথা না।


বিজ্ঞাপন


সরেজমিনে দেখা গেছে, অবাঙালি পরিবারগুলো অনেক আগেই একটি ফ্যান ও একটি লাইটের নিয়ম থেকে সরে এসেছে। যে যার ইচ্ছে মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। অনেক ক্ষেত্রে অপচয়ও হচ্ছে।

উর্দুভাষীদের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত জেনেভা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি ঘরে তিন থেকে চারটি লাইট ও একাধিক ফ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে, চলছে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ওভেন। দোকানপাট, শৌচাগার এমনকি ঘরেও ভরদুপুরে জ্বলছে ১০০ ওয়াটের বাতি। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চলছে লন্ড্রি।

আরও পড়ুন: বিহারি ক্যাম্পে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ২২৮ কোটি টাকা

ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সুবিধা থাকলেও গ্যাস সুবিধা নেই। তাই অবাঙালি এই সম্প্রদায় বৈদ্যুতিক হিটার বানিয়ে রান্না করছে। জেনেভা ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরেই এই হিটারের খোঁজ মিলেছে।

ক্যাম্পের ভেতরে বৈদ্যুতিক অ্যামব্রডারি মেশিন দিয়েও বাণিজ্যিক কাজ চলছে। চলছে বৈদ্যুতিক নানা বাণিজ্যিক কার্যক্রম।

জেনেভা ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্যিক কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্টসংখ্যক বিল দিতে হয় ক্যাম্প নেতাদের। ছয় শতাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিল আদায় করা হয়।

একই চিত্র মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পাশের মার্কেট ক্যাম্পে। পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসবাসের এই ক্যাম্পে ঘরপ্রতি মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হারে পরিশোধ করতে হয়। এই টাকা নেওয়া হয় ক্যাম্পের শৌচাগার পরিষ্কার, ময়লা পরিষ্কার ও বিদ্যুৎ বিল হিসেবে। বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের ব্যবসা বুঝে বিল নির্ধারণ করেন ক্যাম্পের নেতারা।

চলতি মাসের মাঝামাঝি এসে মার্কেট ক্যাম্পে হিটার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন নেতারা। তবে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মার্কেট ক্যাম্পের এক বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, 'বিল তো নেয়। কে পায়, কই যায়, আমরা জানি না। নেতারা বলছেন, হিটার চালানো যাবে না। এত বছর হিটারই তো চালাইছি। এখন না বললে হবে নাকি? নেতারা নাকি আমগো ঘর চেক দিব! তাগো ঘর চেক দিব কে?'

২০০ থেকে ২৫০ টাকা হারে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয় পাশের সেন্টার কমিটি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের। এই ক্যাম্পে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা তিন শতাধিক। জেনেভা ক্যাম্পের মতো এখানেও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদাভাবে বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণ করা হয়েছে৷

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিল আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন সেন্টার কমিটি ক্যাম্পের নেতা মো. সুলায়মান। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'আমরা কোনো বিদ্যুৎ বিল তুলি না। ময়লা পরিষ্কারের জন্য কেউ ৫০ টাকা, কেউ ১০০ টাকা করে দেয়।'

bihari

হিটার ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পুরো দায় চাপান ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ওপর। বলেন, 'লোকজনকে বললে তারা কথা শোনে না। অনেকে হিটার চালায়। আমরা নিষেধ করি। খবর পেলে গিয়ে হিটার ভেঙে দিয়ে আসি।'

মিরপুরের বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরেও একইভাবে বিদ্যুৎতের অপব্যবহার দেখা গেছে। মোহাম্মদপুরের ক্যাম্পের তুলনায় মিরপুরের ক্যাম্পগুলোতে অ্যাম্ব্রডারি কারখানার সংখ্যা বেশি। বিদ্যুৎচালিত এসব মেশিন চলছে ক্যাম্পের সংযোগ থেকেই।

বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিনিময়ে অধিবাসের কাছ থেকে ক্যাম্পের নেতারা বিল আদায় করেন, এই দায় স্বীকার করেছেন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট (ইউএসপিওয়াইআরএম) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু।

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'আমিও জানি অনেক ক্যাম্প থেকেই বিদ্যুৎ বিলের নামে টাকা তোলা হয়। কোথাও ২০ টাকা, ৩০ টাকা তোলা হয়। কোথাও বেশিও তোলা হয়।'

উর্দুভাষী এই নেতা জানান, নিয়ম অনুযায়ী ঘরপ্রতি একটি করে লাইট ও একটি করে ফ্যান ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও তা এখন আর মানা হচ্ছে না।

হিটারসহ বিদ্যুৎতের বাড়তি ব্যবহারের দায় তাদের নয়, বরং বিদ্যুৎতের অপচয় রোধে সরকারি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না বলে দাবি এই বিহারি নেতার।

ফাক্কু বলেন, 'প্রতিটা ক্যাম্পেই ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কমিটি আছে৷ কে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, এটা দেখার দায়িত্ব তাদের। তারা দেখে না কেন?'

কারই/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর