- গণপরিবহনে হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে আতঙ্কে থাকেন যাত্রীরা।
- প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতবদল হচ্ছে।
- বাস, বাড়ি, নবজাতক, বিয়েবাড়ি- সব জায়গায় চাঁদার চাপ।
- নারী যাত্রীরা থাকেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া সমস্যা কমবে না।
ঢাকার রাস্তায় ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয় মানুষের দৌড়ঝাঁপ। কেউ যান অফিসে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবার কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে। যানজট, ভাড়া বৃদ্ধি, দুর্ঘটনার ভীতি-এসবের সঙ্গে রাজধানীর মানুষকে এখন আরেকটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিন। তা হলো গণপরিবহনে হিজড়াদের উৎপাত।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর প্রায় সব রুটেই এই দৃশ্য এখন নিত্যদিনের। সিগন্যালে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই অথবা বাস চলা শুরু হতেই একদল হিজড়া তাল বাজিয়ে, গান গেয়ে বা নানা অঙ্গভঙ্গি করে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর শুরু হয় টাকার জন্য চাপ। স্বেচ্ছায় দিলে শান্তি, না দিলে গালাগালি, ভয়ভীতি বা অশ্লীল আচরণ এমন চিত্রই প্রতিদিনের।
বাসরুটের দৈনন্দিন চিত্র বলছে, প্রতিদিন লাখো টাকা হাতবদল হচ্ছে এইভাবে। অফিসগামী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী-প্রায় সবার পকেট থেকেই খসে যাচ্ছে টাকা। এতে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, মানসিক চাপেও ভুগতে হয় মানুষকে। দিনের শুরুটা ভোগান্তিতে, আর দিনের শেষে ফিরতেও একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
যাত্রীদের অভিযোগ, গণপরিবহন এমন একটি জায়গা যেখানে তারা অন্তত নিরাপদ ও স্বস্তিতে ভ্রমণ করতে চান। কিন্তু প্রতিদিনই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ায় তারা বিরক্ত।
নাগরিকরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি হিজড়াদের জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করলে তারা জীবিকার জন্য অন্যকে হয়রানির পথ ছেড়ে আসতে পারবেন।
বনানী থেকে গাবতলী, মিরপুর থেকে গুলিস্তান, ফার্মগেট থেকে যাত্রাবাড়ী-সব জায়গাতেই একই অবস্থা দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি বাসেই হিজড়াদের এমন কার্যকলাপ নিয়মিত।
ফার্মগেট থেকে প্রতিদিন মতিঝিলে অফিস করেন কামরুল ইসলাম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে অফিসে যাই, কিন্তু বাসে ওঠা মানেই মানসিক চাপ। জানি, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা উঠবে। টাকা না দিলে খারাপ কথা বলে। দিনের শুরুতেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, এতে মন খারাপ হয়ে যায়।’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘হিজড়াদের কাছে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বিব্রত হই। কেউ না দিলে নানা রকম মন্তব্য শোনায়, ভয়ও দেখায়। মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হয়। না হলে মনে হয় আরও বড় ঝামেলায় পড়ব।’
শুধু যাত্রী নন, চালক ও সহকারীদেরকেও পড়তে হয় সমস্যায়। কাকরাইল থেকে গাজীপুরগামী বাসচালক আব্দুল গফুর বলেন, ‘ওরা বাসে উঠলেই পুরো পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়ে যায়। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ নেমেও যায়। এতে গাড়ি চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।’
হাসান মাহমুদ নামে বাসের এক যাত্রী বলেন, ‘হিজড়ারা অনেক সময় টাকার জন্য হাত ধরে টানাটানি করে। তখন খুব অস্বস্তি হয়। আমরা কিছু বললে উল্টো তর্কে জড়িয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েই বাঁচি।’
শুধু রাস্তাঘাট নয়, হিজড়ারা বাড়িতেও এমন চাঁদাবাজি করেন। নগরবাসী জানান, কোনো পরিবারে সন্তান জন্ম নিলেই তিন বছর পরও তারা বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে। সাধারণত পাঁচ হাজার টাকার কমে তারা রাজি হয় না; কখনো কখনো দাবির পরিমাণ পৌঁছে যায় দশ, পনের বা বিশ হাজারে। এভাবেই নিয়মিতভাবে বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
রাজধানীর অনেক বাসিন্দাদের অভিযোগ, হুমকি-ধমকি এবং অশোভন আচরণের কারণে টাকা দিতে বাধ্য হন তারা। এতে বাচ্চা হওয়ার পর পরিবারগুলোর আতঙ্কে দিন কাটে।
মিরপুর ১০ এর বাসিন্দা গৃহবধূ রিমা আক্তার জানান, ‘আমাদের এলাকায় প্রায়ই কিছু হিজড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা দাবি করেন। সন্তান জন্মের খবর পেলেই তারা বড় অঙ্কের অর্থ চায়। আমার মেয়ের বয়স এখন তিন পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো তারা বারবার এসে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা দাবি করছে। অনেক সময় দশ থেকে পনের হাজার টাকার কথাও বলে। না দিলে নানা রকম কথা শুনতে হয়। আমরা কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাই না। মনের মধ্যে সবসময় ভয় কাজ করে।’
কারওয়ানবাজারে পরিবারসহ বাস করা এক গণমাধ্যমকর্মী জানান, ‘আমার মেয়ের জন্মের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও কয়েকজন হিজড়া এসে অর্থ দাবি করেছে। পাশের বাড়ির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকেও তারা ১০ হাজার টাকা দাবি করে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পায়।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গণপরিবহনে হিজড়াদের দ্বারা যাত্রীদের হয়রানির অভিযোগ নিয়মিত পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে বিশেষ অভিযানও চালানো হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে সমাধান পেতে হলে তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম বলেন, ‘যাত্রীবাহী যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনও যথেষ্ট নিয়মনীতি ও ম্যানেজমেন্ট নেই। শুধু মেয়েরাই নয়, ছেলে যাত্রীরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন। মূল সমস্যার একটি হলো-দৃষ্টান্তমূলক বিচার নেই। অপরাধীদের যদি কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তবে এই ধরনের অপরাধ স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।’
সালমা বেগম আরও বলেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায়সহ সংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত সকল মানুষের অধিকার ও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সরকারের তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ ও উদ্যোগও নিশ্চিত করা উচিত। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, শুধু আইনগত ব্যবস্থা নয়, সামাজিক মনোভাবেও পরিবর্তন আনা। সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের জন্য মানসম্মত সুযোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’
এএইচ/এমআর

