আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রবাসীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইতোমধ্যে ৪৯ কোটি টাকার আলাদা প্রকল্প গ্রহণসহ পোস্টাল ব্যালটের জন্য ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে ইসি। তবে পোস্টাল বিদেশ থেকে আসার পর তা কোথায় সংরক্ষণ করা হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
ইসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী ও দেশের মধ্যে পোস্টাল ব্যালট কার্যকর করে ৮০ কর্মকর্তা কাজ করবেন। এছাড়া পোস্টাল আসার পর তা কোথায় রাখা হবে, কার দায়িত্বে থাকবে, কার সামনে এই পোস্টাল ব্যাটলগুলো খোলা হবে, কোনো প্রার্থী খুব সামান্য ভোটে হেরে গেলে পোস্টাল ব্যালটকে বিতর্কিত করতে চাইলে কমিশন কী পদক্ষেপ নেবে- এমন কয়েকটি প্রশ্ন কমিশনের কর্মকর্তাদের মনে জেগেছে।
বিজ্ঞাপন
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, সম্প্রতি পোস্টাল ব্যালট নিয়ে ভবিষ্যতে যেসব বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো পোস্টাল ব্যালট কোথায় সংরক্ষণ করা হবে? এখানে কর্মকর্তাদের পক্ষে থেকে বলা হয়েছে, পোস্টাল ব্যালটে যে ভোটগুলো আসবে তা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার নাম লিখে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ভোটের দিন ভোটগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা ডাক বিভাগেই সংরক্ষিত রাখা হবে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর ডাক বিভাগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর নির্ধারিত এজেন্টদের নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে পোস্টাল ব্যালটগুলো আনা হবে এবং তাদের সামনেই প্রতিটি ব্যাটল খুলে ভোট গণনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এমন সুপারিশ আমরা কমিশনের কাছে করেছি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিগত তিন নির্বাচনে আমরা অনেক বিতর্কের শিকার হয়েছি। এবার জাতিকে একটা সুন্দর ভোট উপহার দেওয়াসহ কমিশনকে নিয়ে যাতে জনগণ আর কোনো বিতর্ক করতে না পারে এ জন্য ভোটের দিন যেসব বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো কীভাবে এড়ানো যায় তা নিয়ে আগে থেকেই ভাবছি।
পোস্টাল ব্যালট কোথায় রাখা হবে এ বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, প্রবাসীরা আগেই ভোট দিলেও সেগুলো ট্রেজারিতে থাকবে। ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট আসনের ভোটগ্রহণ শেষে গণনা করা হবে।
প্রবাসী ভোটের জন্য আসছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ
নিবন্ধিত প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারসহ দেশের অভ্যন্তরে ভোটে নিয়োজিত কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা ও আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। আর এজন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে একটি অ্যাপ।
এ বিষয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিবন্ধনের জন্য তৈরি হচ্ছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামের অ্যাপ। নিবন্ধিতদের নির্ধারিত পদ্ধতিতে যথাসময়ে পোস্টাল ব্যালট পেপার পাঠানোর পর ভোট দিয়ে ফেরত আনা হবে দেশে।
প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার প্রাথমিক পদ্ধতি তুলে ধরে ইসি সচিব বলেন, ‘নিবন্ধিতরাই পোস্টাল ব্যালট পেপারে ভোট দিতে পারবেন। কোনো প্রবাসী নিবন্ধন করে দেশে এসে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। নিবন্ধনের জন্য postal vote bd নামে অ্যাপ তৈরি হচ্ছে।’
আরও পড়ুন
পোস্টাল ব্যালটে ব্যয় হবে ৪০০ কোটি টাকা
প্রবাসীদের ভোটার করতে ‘উদার’ ইসি, মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্টেও সুযোগ
তিনি জানান, এই অ্যাপটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। কবে নাগাদ নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হবে তা জানানো হবে পরে। এছাড়া ডাক বিভাগের মাধ্যমে ব্যালট পেপার কবে পাঠানো হবে এবং প্রবাস থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আসবে- তা তফসিলের ওপর নির্ভর করছে। সেজন্য পরে বিস্তারিত গণমাধ্যমে জানানো হবে।
যেভাবে পৌঁছাবে পোস্টাল ব্যালট
প্রবাসীদের ডাকযোগে ভোটগ্রহণে নতুন পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্দিষ্ট সময়ে পাঠানো খামে ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নাম থাকবে না, শুধু থাকবে প্রতীক। প্রতীকের পাশে নির্ধারিত ঘরে টিক বা ক্রস চিহ্নে ভোট দিয়ে তা ফেরত পাঠাতে পারবেন প্রবাসীরা।
এ বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে খাম পাঠানো হবে প্রবাসীদের কাছে। ব্যালট পেপারে ক্যান্ডিডেটদের নাম থাকবে না। শুধু থাকবে সিম্বল এবং সিম্বলের পাশে একটা স্পেস করে দেওয়া থাকবে। সেই স্পেসে তারা টিক চিহ্ন অথবা ক্রস চিহ্ন দিয়ে ভোটটা দেবেন।’
তিনি জানান, একটি বড় খামের মধ্যে তিনটি খাম দিয়ে প্রবাসীদের ঠিকানায় পাঠানো হবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে। একটি ব্যালট পেপার, আরেকটি খামের ভেতরে থাকবে। ভোট দেওয়ার পর আরেকটি খাম ফেরত পাঠাবে। এরমধ্যে নির্দেশনাও থাকবে।
প্রবাসীদের ভোটের বিষয়টি কবে শুরু হবে জানতে চাইলে আখতার আহমেদ বলেন, এটা কবে নাগাদ শুরু করতে পারব তা সিডিউল ঘোষণার সাথে সম্পর্কিত। এটা সিনক্রোনাইজ করে পরে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী, পোস্টাল ব্যালটে ভোটদান নিশ্চিত করতে একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করবে কমিশন। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোবাইল অ্যাপ তৈরি ও পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে, যেখানে প্রার্থী ও প্রতীক যুক্ত থাকবে। ১ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অ্যাপের ট্রায়াল, নীরিক্ষা ও ত্রুটি সংশোধন চলবে। একই সঙ্গে জানুয়ারি পর্যন্ত ওসিভি ও আইসিপিভি ভোটারদের জন্য প্রচারণা ও ভোটার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
১ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে ব্যালট পেপার, নির্দেশিকা ও ঘোষণাপত্র মুদ্রণ হবে। নিবন্ধন শুরু হবে ১১ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর ডাকবিভাগ খাম কাস্টমাইজ করবে এবং ২০ নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটারদের কাছে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে। তফসিল ঘোষণার পর প্রতীক বরাদ্দ শেষ হলে ওসিভি ও আইসিপিভির আওতায় ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। ভোট প্রদান শেষে ব্যালট পেপার দেশে ফেরত পাঠাতে হবে নির্বাচনের এক মাস আগে, পরে তা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে সিল করা অবস্থায় পাঠানো হবে।
ইসি আব্দুর রহমানেল মাসউদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা যে সিস্টেম করেছি, পোস্টালে একটা স্ট্যাম লাগিয়ে দেব। ভোটার বিদেশ থেকে অনলাইনে আমাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে নাম লিস্ট করবেন বা দেশে থেকেও করতে পারবেন, একই সিস্টেম। একটা ইনকান্ট্রি, আরেকটা আউটকান্ট্রি।’
ইসি বলেন, ‘ভোটিংয়ের জন্য ভোটাররা নিবন্ধন করবেন। কে কোন সময় করবেন, আমরা চার রকম ব্যক্তির নাম দিয়ে রেখেছি, তার সময় দিচ্ছি। আর বিদেশ থেকে যারা দেবে তাদের জন্য কমিশন থেকে পাস হওয়ার পর সার্কুলার জারি করব যে, এত থেকে এত তারিখের মধ্যে আপনি নাম নিবন্ধন করবেন।’
আব্দুর রহমানেল মাসউদ বলেন, ‘আগে ব্যালট পাঠালে সেই ব্যালট পেপার ফেরত আসত না, ভোট দিতেও পারত না, আর এলেও শেষের দিকে আসত। এখন সেখানে আমরা ব্যালট পেপার না দিয়ে যত আমাদের মার্কা আছে সব মার্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। উনি মার্কা অনুযায়ী ভোট দেবেন।’
জানা যায়, প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এক কোটি ৩০ লাখের মতো বা কিছু বেশি প্রবাসী রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ বাংলাদেশির এনআইডি আছে। সেই হিসেবে ৫০ লাখের মতো ভোটার পাওয়ার আশা করছে ইসি। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটের হার ২০ থেকে ২২ শতাংশের মতো হয়।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম ভাষণেই প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তিনটি পদ্ধতি আলোচনা করে, যেখানে পোস্টাল ব্যালটের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়। ফলে আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালটব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে ইসি। প্রবাসীদের পাশাপাশি ৭১ জেলের কয়েদি এবং ভোটের দায়িত্বে থাকা সরকারি চাকরিজীবীরাও এই সুযোগ পাবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন আহমদ ইতিমধ্যে বলেছেন, পরীক্ষামূলক বা সীমিত পরিসরে হলেও এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চায়। এজন্য প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রমও ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
বর্তমানে ১০ দেশের ১৭টি দূতাবাসে ভোটার নিবন্ধন ও এনআইডি সরবরাহের কাজ করছে ইসি। দেশগুলো হলো-সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান। শিগগিরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশপাশি আরও অন্তত চারটি দেশে শুরু হতে পারে ভোটার নিবন্ধনের এই কাজ।
সবশেষ ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে এখন ভোটার ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫৯৪ জন। পুরুষ ভোটার ৬ লাখ ৪১ লাখ ৪৫৫ জন এবং নারী ভোটার ৬ লাখ ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন। হিজড়া ১২৩০ জন।
এমএইচএইচ/জেবি

