শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু, দায়সারা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

DENGUE
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু। ছবি কোলাজ: ঢাকা মেইল

দেশে এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা বেড়েই চলছে। কেড়ে নিচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার প্রাণ। বাদ যাচ্ছে না তরুণরাও। চলতি বছরে প্রায়ই ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড ভাঙছে। গতকাল রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি চলতি বছরে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭৯ জন। আর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ হাজার ৮৩১ জন।


বিজ্ঞাপন


স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সভিত্তিক রোগী ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. সৌরভ সাহা। রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালের দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

জানা গেছে, ৪২তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে কর্মরত ছিলেন ডা. সৌরভ সাহা। স্বপ্ন ছিল বড় চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করবেন। ইতোমধ্যে জয় করেছেন হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারিতে এফসিপিএস ও এমএস পেজ এ। ক্যারিয়ারে কঠিন কঠিন ধাপ পার করে ডেঙ্গুর কাছে হার মানলেন তরুণ মেধাবী এই চিকিৎসক।


বিজ্ঞাপন


চলতি মাসে মৃত্যু-আক্রান্ত বেশি

সাধারণত বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ আগের মাসগুলোর চেয়ে বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, তা এ সময়ে আগের কোনো মাসে হয়নি। এ বছর যত আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে, তা গত বছরের এ সময়ের চেয়ে বেশি।

Dengue2
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মৃত্যুহার বাংলাদেশে

চলতি বছর বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বরিশালের মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মৃত্যুহার ১ দশমিক ২ শতাংশ। একে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন

বরগুনা কেন হয়ে উঠল ‘এডিসের আধার’

১০ জনের ৬ জনই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত, সতর্কতার তাগিদ

তবে সার্বিকভাবে মৃত্যুহার এবার কম। গত বছর ডেঙ্গুতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫৬। এটি ছিল বিশ্বে সর্বোচ্চ। চলতি বছর এ হার শূন্য দশমিক ৩৯। আর এ বছর বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার ইন্দোনেশিয়ায়, শূন্য দশমিক ৪৩।

মৃত্যুহার কম হলেও গত বছরের চেয়ে রোগীর সংখ্যা তিন গুণ বেশি। মৃত্যুহারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। ভারতে চলতি বছর মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১০। পাকিস্তান ও নেপালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই।

দায়সারা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর উচ্চহার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। এখানে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নতুনত্ব কিছু নেই। সবকিছু যেন চলছে দায়সারাভাবে। সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই।

এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কার্যক্রম নেই। বিষয়টি একেবারে গা–সওয়া হয়ে গেছে। সরকারের কোনো ভাবনা নেই। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঢাকার বাইরে এবার যে ডেঙ্গু বাড়তে পারে, তা শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থাই নেই।’

Dengue3
ঠাঁই হচ্ছে না হাসপাতালে। ছবি: সংগৃহীত

জানতে চাইলে আইইডিসিআর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর মৃত্যু কমাতে হলে চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রাথমিক, মধ্যম ও জটিল; সব রোগের চিকিৎসা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা বড় হাসপাতালগুলোতে। এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক বাড়ালেও বাড়ে না রোগীর বেড। নেই আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ব্যবস্থা, যা আছে তাতে সব রোগীর হয় না। অনেকেই আছে ডেঙ্গুর লক্ষণে ভোগেন, কিন্তু টেস্ট করান না। হাসপাতালে গেলে অনেক সিরিয়াল, হয়রানি। দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র, চিকিৎসা করার মতো টাকা থাকে না। হঠাৎ করে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরীক্ষা করে দেখেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত; তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।’

আরও পড়ুন

দশকের পর দশক ধরে অকার্যকর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা

সাপের কামড়ে মৃত্যু বাড়ছে, প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে টেস্টের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ঘনবসতি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে হলে স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে শিশু ও গর্ববতী নারীসহ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের আগে থেকে হাসপাতালে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ডাক্তার আর নার্স চেকআপ করলে তাদের অবস্থা খারাপ হবে না। খারাপ পরিস্থিতির আগে তাদের বড় হাসপাতালে পাঠানো হবে। এভাবে করলে চিকিৎসা দেওয়া সহজ হবে এবং জটিল রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। তাতে মৃত্যু অনেক কমে যাবে।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মশক নিধন কর্মসূচি সন্তোষজনক নয় জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এভাবে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু মোকাবিলায় কোনো নতুন ধরনের উদ্যোগ দেখা গেল না। সেই গতানুগতিক ধারাতেই চলছে সবকিছু। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব আছে, সেসব এলাকায় নিয়মিতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সেইসঙ্গে এলাকাবাসীকে সচেতন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারাদেশে একসঙ্গে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে এই কাজ করতে হবে।’

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর