- দেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ
- জেলা-উপজেলায় ডায়াবেটিস চিকিৎসা সেবা ও অবকাঠামো সীমিত
- মানসিক চাপ ও নগরায়নের প্রভাব তরুণদের ঝুঁকিতে ফেলছে
- চিকিৎসা না পেলে ভবিষ্যতে কিডনি, হার্ট, চোখ, ও স্নায়ুর জটিলতা বাড়বে
বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৭০ শতাংশের মতো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী তাদের রোগ সম্পর্কে জানেন না, আর ৫০ শতাংশ রোগী যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সচেতনার অভাব, তীব্র জীবনযাপনের পরিবর্তন, ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে তরুণদের মধ্যেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিকিৎসার অভাব, উচ্চ ব্যয় ও বিশেষজ্ঞের ঘাটতিতে দেশজুড়ে ডায়াবেটিস এখন শুধু একটি রোগ নয়, এটি এক আজীবনের সংগ্রাম।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের (এনসিডিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশের চিকিৎসা সেবার সুযোগ রয়েছে। আর বাকি ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
চিকিৎসায় সংকট
বর্তমানে দেশের ১৪টি মেডিকেল কলেজে এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ মুহূর্তে প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ৩০ বছরের বেশি বয়সের সবাইকে পরীক্ষা করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। অথচ তাদের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ (অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্ট) চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২০০ জন। সে হিসেবে প্রতি ৫৬ হাজার রোগীর সেবায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র একজন। আর মোট জনসংখ্যা হিসাবে প্রতি ১২ লাখ মানুষের জন্য ডায়াবেটিস চিকিৎসক রয়েছেন একজন। এমনকি দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল। ফলে রোগীদের ৩৫ শতাংশই চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসার আওতায় রয়েছেন ৬৫ শতাংশ রোগী।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
চিকিৎসকরা দেশে ডায়াবেটিস রোগী অনুপাতে চিকিৎসক সংকটেরও কথা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, দেশে রোগটির মানসম্মত চিকিৎসা দিতে প্রায় ২০০ জন (অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্ট) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। এতে তৃণমূলে রোগীরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে এখনই অন্তত জেলা হাসপাতালগুলোতে অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ খোলা ও চিকিৎসক বাড়াতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক ঘাটতি ও সংকট রয়েছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জেলা ও উপজেলায় সেন্টার তৈরি করতে হবে। যেখানে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় সকল সুযোগ সুবিধা থাকবে এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এগুলো করতে হবে সরকারিভাবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সরকারিভাবে সরবরাহ করতে হবে।
বেনজির আহমেদ বলেন, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা এখন অনেকের জন্যই এক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিস এখন শুধু একটি রোগ নয়, এটি এক আজীবনের সংগ্রাম। নিয়মিত পরীক্ষা, ইনসুলিন বা ওষুধের খরচ, খাবারে নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে যেন নাভিশ্বাস উঠে যায় এবং হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন। আবার সরকারি সহায়তা বা সাশ্রয়ী চিকিৎসা কেন্দ্রের অভাবেও অনেকেই সঠিক চিকিৎসা পায় না।
তরুণরাও আক্রান্ত ডায়াবেটিসে
তরুণদের মধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস রোগ। এর কারণ জানতে চাইলে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাজাদা সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি হলো তরুণরাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর কারণ হলো শারীরিক শ্রম কমে যাওয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস। সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ এবং মানসিক চাপসহ নানা কারণ রয়েছে। মিষ্টি-মধু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশে মানুষ এগুলো ব্যাপক হারে খায়।
শাহাজাদা সেলিম বলেন, চর্বি জাতীয় খাবারও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি করে। আর এগুলো সবচেয়ে বেশি খায় তরুণরা। সুস্থ থাকার জন্য বিনোদনের সুযোগও কমে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজের নেই খেলাধুলার মাঠ, যেখানে গিয়ে বিনোদন কিংবা মানসিক শান্তি নেওয়া যাবে। বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে তরুণরা।
ডা. শাহজাদা সেলিম আরও বলেন, সারাদেশের বিভিন্ন শহরে করা গবেষণায় দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী তাদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন না। অথচ এসব রোগীর কিছুদিন পর কিডনি ও চোখ নষ্ট হবে, হার্ট অ্যাটাক হবে, স্ট্রোক হবে। কাজেই তাদের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। কিন্তু যেহেতু তার রোগ সম্পর্কে জানে না, তাই সে চিকিৎসাও করাবে না।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, মানুষকে জানতে হবে ডায়াবেটিস একবার হলে আপাতত নিরাময়যোগ্য নয়, রোগটি প্রতিরোধ করতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু তারা তো জানেই না তারা রোগী। তাহলে তারা প্রতিরোধ করবে কীভাবে? এই দুটো কারণে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা খুব প্রয়োজন। সচেতন হতে হলে আগে টেস্ট করে নিতে হবে রোগ আছে কি না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিস রোগী বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। কিন্তু কত হারে বাড়ছে সেটা বলা মুশকিল। তবে অনেক বেশি বাড়ছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। এই যে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড, কায়িক পরিশ্রম না করার কারণে মুটিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগী বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বাড়ছে ডায়াবেটিস
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে ডায়াবেটিস রোগ বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বিশেষ করে অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। এই ধরনের জীবনযাপন ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডায়াবেটিস হৃদযন্ত্র, রক্তনালি, চোখ, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। ডায়াবেটিস প্রতিবন্ধিতা ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংস্থাটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে শরীরের ওজন ঠিক রাখা, নিয়মিতভাবে দৈনিক ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করা, বেশি পরিমাণে সবজি ও ফলমূল খাওয়া, ধূমপান এড়িয়ে চলা ও মদ্যপান সীমিত করা, স্বাস্থ্যঝুঁকি জানা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং ব্যবস্থাপত্র মেনে ওষুধ সেবন করা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়
খাবার নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম ও ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি যদি রক্তের চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে তিনি নন ডায়াবেটিক একজন মানুষের মতোই পরিশ্রম করতে পারবেন। আর যদি রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে ডায়াবেটিস দেহের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হলে, বেড়ে যাওয়া চিনিসহ রক্ত সারাদেহে পৌঁছে যায়। তখন কিডনি, লিভার, হার্ট রক্তনালিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের অসুখ তৈরি হয়। এক অসুখ থেকে সৃষ্টি হয় আরেক অসুখ।
এজন্য ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে অবহেলার পরিবর্তে নিয়মিত রক্তের চিনির মাত্রা মাপতে হবে। জীবনযাপন পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। চিকিৎসকরা রোগীকে ওষুধ বা ইনসুলিন ইনজেকশন দেন রক্তে শর্করার মাত্রা যাচাই করে। এই দুই ধরনের পরিস্থিতিতেই নিয়মিত রক্তের চিনির মাত্রা মাপতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডায়াবেটিস হৃদযন্ত্র, রক্তনালি, চোখ, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। ডায়াবেটিস প্রতিবন্ধিতা ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংস্থাটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে শরীরের ওজন ঠিক রাখা, নিয়মিতভাবে দৈনিক ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করা, বেশি পরিমাণে সবজি ও ফলমূল খাওয়া, ধূমপান এড়িয়ে চলা ও মদ্যপান সীমিত করা, স্বাস্থ্যঝুঁকি জানা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং ব্যবস্থাপত্র মেনে ওষুধ সেবন করা।
এসএইচ/এমআর














