শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ডায়াবেটিস: নীরব যন্ত্রণায় ধুঁকছে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষেরা

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০২ এএম

শেয়ার করুন:

ডায়াবেটিস: নীরব যন্ত্রণায় ধুঁকছে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষেরা
ডায়াবেটিস: নীরব যন্ত্রণায় ধুঁকছে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষেরা
  • চিকিৎসা ব্যয়ের ভারে ন্যুব্জ অনেক পরিবার
  • অনেকে জানেই না ডায়াবেটিস আছে কি না 
  • চিকিৎসা নিতে হিমশিম খায় নিম্নবিত্তরা 
  • সচেতনতা বাড়ালে ৭০ শতাংশ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব 
  • লক্ষণ দেখলেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শের আহ্বান

ডায়াবেটিস এমন এক ‘নীরব ঘাতক’ যা নিঃশব্দে শরীরের ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয় চোখ, কিডনি, স্নায়ু ও হৃদযন্ত্রকে। দেশে এই রোগ এখন মহামারির পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছেন গরিব, নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষ, যারা জানেনই না তারা এই রোগে আক্রান্ত কি না কিংবা জানলেও চিকিৎসার খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই।


বিজ্ঞাপন


রিকশা শ্রমিক, শ্রমজীবী মানুষ কিংবা অল্প আয়ের মানুষেরা অনেকেই শরীরের যত্নের ব্যাপারে সচেতন নয়। তারা দিনে আনে দিনে খায়। দৈনন্দিন জীবন নির্বাহে তারা রীতিমতো হিমশিম খায়। হঠাৎ অতিরিক্ত খরচের চাপ পড়লে তাদের দ্বারস্থ হতে হয় অন্যের ওপর। ফলে তারা ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার বিষয়টি চেপে যায়।

বেকার স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করছেন রাজধানীর গেন্ডারিয়ার আকলিমা বেগম। ছেলের সামান্য চাকরি ও পারিবারিক কিছু আয় দিয়ে টেনেটুনে চলে তাদের সংসার। গত এক বছর আগে ডাক্তারের কাছে গেলে আকলিমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, অনেক আগে থেকেই তিনি ডায়াবেটিসের আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হননি তিনি। ফলে এখন তার সুগার রেট ১৫ থেকে ১৭ পর্যন্ত উঠেছে। শুরুতে ডায়াবেটিস নির্ণয় করা গেলে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, শরীর চর্চাসহ কিছু অনুসরণ করলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কিন্তু এখন তার শরীরের পরিস্থিতি অনুযায়ী দৈনিক দুই বেলা ইনসুলিন নিতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আকলিমার পরিবার দিশেহারা। ডায়াবেটিসের পাশাপাশি নানা রোগ দানাবেঁধে ওঠেছে তার শরীরে। আকলিমা ঢাকা মেইলকে বলেন, ডায়াবেটিসের আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছি না। ঠিকঠাক খাবার খেতে পারছি না। সকাল-বিকেল নিয়ম করে ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হচ্ছে। দিন দিন খরচের খাতা বাড়ছে। ইনকামের জায়াগা বাড়ছে না। আমাদের মতো গরিব মানুষের ডায়াবেটিস হলে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

দৈনন্দিন সংগ্রামের ভেতরে হারিয়ে যায় নিজের যত্ন


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর ডেমরায় রিকশা চালক শহিদুল (৫০) প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি রিকশা চালান। গত এক বছর ধরে তিনি ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত পিপাসা ও ওজন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গে ভুগছেন। কিন্তু কখনো চিকিৎসকের কাছে যাননি।

শহিদুল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একদিন ফার্মেসিতে গিয়ে বললাম, শরীর দুর্বল লাগে। তারা বলল, চিনির সমস্যা হতে পারে। কিন্তু পরীক্ষা করানো দরকার। পরীক্ষার টাকা দিতে পারিনি।’

এমন গল্প শুধু শহিদুলের নয়। নগরীর গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুর, ভ্যানচালক থেকে শুরু করে গৃহকর্মী পর্যন্ত হাজারো মানুষ প্রতিদিন কষ্টের পয়সায় সংসার চালায়। নিজেদের শরীরের যত্ন নেওয়ার বিলাসিতা তাদের নেই।

অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে বাড়ছে ঝুঁকি

গ্রামীণ ও শহরতলীর মানুষের মধ্যে এখনো ডায়াবেটিস বিষয়ে সচেতনতা খুব সীমিত। অনেকেই মনে করেন ডায়াবেটিস কেবল ধনী বা মোটা মানুষদের রোগ।

চাঁদপুরের আবুল কাশেম (৪৫), একজন ইটভাটা শ্রমিক। তিনি বলেন, আমার মনে হতো গরিব মানুষে ডায়াবেটিস হয় না। এখন বুঝি, রোগ ধনী-গরিব দেখে আসে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অজ্ঞতা ভয়াবহ। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু বিলম্বে ধরা পড়লে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।

চিকিৎসা ব্যয়ের ভারে ন্যুব্জ পরিবারগুলো

ডায়াবেটিস আজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়—নিয়মিত ওষুধ, ইনসুলিন, রক্ত পরীক্ষা ও নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে হয়।

একটি ইনসুলিনের ফাইলের দাম ৫০০-৮০০ টাকা, যা একজন শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশাল খরচ। মাসে তিন-চারটি ইনসুলিন লাগলে ব্যয় দাঁড়ায় কয়েক হাজার টাকা, সঙ্গে থাকে টেস্ট স্ট্রিপ, ডায়েট ও অন্যান্য ওষুধের খরচ।

আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিক রুবিনা জাহান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার স্বামীও অসুস্থ। আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, কিন্তু ইনসুলিন কেনার টাকা জোটে না। মাঝে মাঝে ওষুধ না খেয়ে থাকি। শরীরটা এখন খুব খারাপ।’

এমন অবস্থায় অনেক পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে ধারদেনা করে, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। ফলে একসময় অন্ধত্ব, কিডনি বিকল হওয়া বা পক্ষাঘাতের মতো জটিলতা দেখা দেয়।

13

সরকারি সহায়তার সীমাবদ্ধতা

দেশে সরকারি হাসপাতাল ও ডায়াবেটিক সমিতির অধীনে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসার কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তা নগরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ বা শহরতলীতে এসব সুবিধা প্রায় অপ্রতুল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডায়াবেটিস এখন শহর- গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীতেও ছড়িয়েছে। কিন্তু সরকারি সেবা ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম এখনো পর্যাপ্ত নয়।’

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালায় ডায়াবেটিসকে ‘প্রাধান্যপ্রাপ্ত অসংক্রামক রোগ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তহবিল সংকট ও জনবল ঘাটতির কারণে উদ্যোগগুলো কার্যকর হচ্ছে না।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি

ডায়াবেটিস চিকিৎসা এখন সমাজে বৈষম্যের নতুন চিত্র। ধনী শ্রেণি আধুনিক চিকিৎসা, ডায়েট প্ল্যান ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে, আর গরিব মানুষ দিনশেষে একটি ভাতের থালা নিশ্চিত করতেই লড়ছে।

এই বাস্তবতা শুধু স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি একটি মানবিক ও সামাজিক সংকটও।

চিকিৎসকরা বলছেন, আমাদের দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ জানেনই না যে, তারা আক্রান্ত। গরিব মানুষেরা পরীক্ষা করাতে পারে না, নিয়মিত ওষুধ কেনা তো দূরের কথা। এই ব্যবধান দূর করতে হলে সরকারকে কমিউনিটি পর্যায়ে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং চালু করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন রিকশাচালকের মাসিক আয় দিয়ে ইনসুলিন ও নিয়মিত চেকআপ চালানো সম্ভব নয়। তাই সরকার ও এনজিওগুলোর যৌথভাবে ‘সাবসিডাইজড ইনসুলিন স্কিম’ চালু করা উচিত—যাতে দরিদ্র রোগীরাও জীবন বাঁচাতে পারেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডায়াবেটিস একটি মরণব্যাধি। তবে সচেতনতাই এর সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৭০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। আর তার জন্য চাই জীবনযাপনে ও অভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন।’

5

এই চিকিৎসক বলেন, ‘বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর খাবার ও টিফিনে তাদের অভ্যস্ত করতে হবে, প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবারের প্রতি উৎসাহী করতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন নিয়ম করে খেলাধুলা বা কায়িক শ্রম করা জরুরি।’

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনো সেই লড়াইয়ের বাইরে পড়ে আছে।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, এখন সময় এসেছে ‘ডায়াবেটিস চিকিৎসা ধনীদের বিলাসিতা নয়, সবার অধিকার’— এই নীতিতে কাজ করার।

বিনামূল্যে পরীক্ষা, স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ, গ্রামীণ সচেতনতা কার্যক্রম এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা চালু না হলে, ডায়াবেটিস আরও হাজারো দরিদ্র মানুষের জীবনের আলো নিভিয়ে দেবে।

বাংলাদেশের ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলছেন, ‘যাদের ঝুঁকি রয়েছে, তাদের অবশ্যই বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষেরা এখন অনেক ফার্মেসিতে স্বল্পমূল্যে দ্রুত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে পারে। সেখান ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর