* ডায়াবেটিস নিয়ে বস্তিতে সরকারের কোনো সচেতনতা ও রোগ নির্ণয়ের উদ্যোগ নেই
* ৫০ টাকায় ফার্মেসিতে মিলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা
* শরীরের দুর্বলতা থাকলেও জানেন না কোন রোগে ভুগছেন
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে প্রতিদিনই মানুষ লড়ছে নানা দুঃসহ বাস্তবতার সঙ্গে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টিকর খাবার, আর্থিক অনটন—সব মিলিয়ে সেখানে বসবাসকারীদের জীবনে রোগব্যাধি নিত্যসঙ্গী। এসব রোগগুলোর ভেতর কখন যে নীরবে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়াবহ এক রোগ—তা জানতে পারেন না বাসিন্দারা।
বিজ্ঞাপন
বস্তিবাসীদের দাবি, মাঝে-মধ্যে ক্ষুধা লাগলে হালকা মাথা ঘোরা, চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসা–সহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এমন হলে তারা বস্তিতে থাকা ফার্মেসি থেকে স্যালাইন কিনে খেয়ে নেন। তবে অনেক বাসিন্দার শরীরে কোথাও ক্ষত হলে তা শুকাতে দীর্ঘ সময় লাগে। এটা কেন হয় তা তাদের অজানা।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার ক্রমেই বাড়ছে। তবে বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করা এবং পুষ্টিকর খাবারের অভাব—এই সব কারণে অধিকাংশ মানুষ জানতেই পারছেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্তের খবর।
ডায়াবেটিস নিয়ে বস্তিবাসীর ভাবনা:
মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার বস্তিতে বসবাসকারী ৫০ বছর বয়সী রিনা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে শরীর দুর্বল লাগে, চোখে ঝাপসা দেখি। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলে আমাদের বস্তিতে থাকা দোকান থেকে ওরস্যালাইন কিনে এনে খাই। মানুষ বলে ডায়াবেটিস রোগ। কিন্তু এ রোগ আমরা কখনো দেখি নাই। এগুলা বড়লোকের হয়। আমাদের মতো গরিব মানুষের এসব রোগ নেই।”
বিজ্ঞাপন

হাজারীবাগ নিমতলা বস্তির ৪৫ বছর বয়সী বাসিন্দা হনুফা বেগম বলেন, “৩০ বছর যাবৎ আমি এ বস্তিতে বসবাস করি। কখনো ডায়াবেটিস রোগ দেখিনি এবং আশপাশে এ রকম রোগও দেখিনি। হঠাৎ করে একবার আমি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তখন ডাক্তার অন্যান্য রোগের সঙ্গে আমার ডায়াবেটিসও বের করে। ওই সময় আমাকে একটি ডায়াবেটিস মাপার মেশিন কিনতে বললে আমি একটি মেশিন কিনি। এটা দিয়ে এখন বস্তির অনেক লোকের ডায়াবেটিস মেপে দিই। অনেকের ধরা পড়ে, আবার অনেকের নাই। আমার মেশিন কেনার ওসিলায় এ বস্তিতে আমি মানুষের ডায়াবেটিস মাপতে পারি।”
মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান এলাকার ‘১০০ বস্তি’ নামক একটি বস্তির বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী দেলোয়ার হোসেন। তিনি পেশায় একজন অটোরিকশা চালক। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, “আমি আগে পায়ের রিকশা চালাতাম, এখন অটোরিকশা বের হওয়ায় তা চালাই। আমি কোনোদিন ডায়াবেটিসের জন্য ওষুধ খেতে হয়নি। আগে শরীরে কোনো অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু এখন একটু ক্ষুধা লাগার পর মাথা ঘুরে, চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। তবে আমার এত বয়সে কোনোদিন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করিনি। এখনও মনে হয় না পরীক্ষার প্রয়োজন আছে।”

গুলশানের পাশে কড়াইল বস্তিতে গত ২৫ বছর যাবৎ ৫০ বছর বয়সী আসমা বেগম বসবাস করছেন। তিনি আগে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। গত ৩ বছর যাবৎ বস্তির পাশে একটি চায়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, “আমার এ জীবদ্দশায় কোনোদিন দেখিনি বস্তিতে কেউ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা দিতে এসেছে কিংবা ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয় করতে এসেছে। আমাদের বস্তিতে এখন অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বস্তির ফার্মেসিতে গিয়ে আমরা ডায়াবেটিস মেপে আসি। প্রতিদিন ডায়াবেটিস মাপতে জনপ্রতি ৫০ টাকা করে দিতে হয়। তবে অনেকে জানেই না তাদের ডায়াবেটিস আছে কি নেই।”
কানন পালী নামে সিকদার মেডিকেলের একজন সিনিয়র নার্স গত দুই বছর যাবৎ ধানমন্ডি লেকে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের কাজ করছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি আগে সকাল ৬টা থেকে ডায়াবেটিস পরীক্ষার কাজ করতাম। প্রতিদিন একজন করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে জনপ্রতি ৪০–৮০ টাকা নেই। প্রতিদিন প্রায় ২০০–২৫০ জন লোক ডায়াবেটিস মাপতে আসে। ধানমন্ডি লেকে আমার মতো প্রায় আরও ১৫–২০ জন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে বসে। প্রতিদিন অনেক লোক হাঁটতে আসে।”

জিয়া উদ্যান এলাকায় গত ৩ বছর যাবৎ ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য কাজ করছেন আহমেদ মিয়া। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, “আমি গত ৩ বছর যাবৎ ডায়াবেটিস পরীক্ষার কাজ করছি। প্রতিদিন ভোরে অসংখ্য মানুষ হাঁটতে আসে। সবাই মোটামুটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সবাই ডায়াবেটিস মাপতে আসে। প্রতিদিন এমনও হয়—পুরো এলাকায় আমরা ১৫–২০ জন লোক ডায়াবেটিস মাপার কাজ করি। সবার এখানে ভিড় থাকে। এ রোগটা এতই ছড়িয়েছে, যার ফলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।’
দীর্ঘদিন যাবৎ স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করছেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বস্তি এলাকাগুলোতে নিয়মিত স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম চালানো, বিনামূল্যে রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কে সহজ ভাষায় প্রচারণা চালানো জরুরি। এ প্রচারণাগুলো বস্তির মধ্যে নেই। কখনো সরকার নিজ উদ্যোগে বস্তিগুলোতে ডায়াবেটিস পরীক্ষা কিংবা এ রোগের খরচ এবং সচেতনতা সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।’

মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা কাজল কলি (ছদ্মনাম) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যদিও ডায়াবেটিস পরীক্ষা সুবিধা রয়েছে, কিন্তু বস্তিবাসীর অনেকে জানেনই না সেখানে তারা বিনামূল্যে পরীক্ষা করাতে পারেন। ফলে রোগ শনাক্তের আগেই অনেকের শরীরে দেখা দিচ্ছে জটিলতা—চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, ক্লান্তি, এমনকি ঘায়ের বিলম্বিত সাড়াও।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বস্তিবাসীর মধ্যে ডায়াবেটিস শনাক্ত ও প্রতিরোধে সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতাই পারে এই ‘অজানা রোগ’-এর বিস্তার রোধ করতে।
একেএস/এআর














