উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমানোর উদ্দেশ্যে ২০২০ সালে চালু হয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। ইতিমধ্যে দুবার এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও দুবারই পরীক্ষা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রতিবারই পরীক্ষা থেকে সরে আসার কথা শোনা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে। এমন অবস্থার মধ্যেই তৃতীয়বারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে।
বর্তমানে তিনটি গুচ্ছে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় গুচ্ছ সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ৮টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজ্ঞাপন
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলার পরও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নাম লেখায়নি স্বনামধন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
নানা অভিযোগ শোনা গেলেও এ পদ্ধতিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমেছে, কমেছে খরচও। কিন্তু নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপত্তি জানিয়ে আসছে। কিছুদিন আগে গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলোচনায় বসা হয় গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক নেতাদের সাথে। বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী জানান, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ই আসছে গুচ্ছে। কিন্তু আলোচনার পরও ফের বেঁকে বসেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ।
গুচ্ছের ঘোষণা আসার পর প্রথম বছরেই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। গুচ্ছে তিন বিভাগে (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা প্রশাসন) পরীক্ষার ঘোষণা আসে। এসময় শিক্ষার্থীরা দাবি জানান, সাধারণ (ইংরেজি, বাংলা ও সাধারণ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন) একটি বিভাগ রাখার জন্য। কিন্তু তাতে সায় দেয়নি কর্তৃপক্ষ। আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি, কিন্তু লাভ হয়নি। আবার অধিকমাত্রায় ভর্তি ফি নিয়েও ছিল অসন্তোষ।
দ্বিতীয়বার গুচ্ছ পরীক্ষায় দেখা দেয় নতুন সমস্যা। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিষয়ের আবেদনের জন্য গুণতে হয় আবেদন ফি। ফলে একেক শিক্ষার্থীর ভর্তি আবেদনে চলে যায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে বছরব্যাপী ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থী পায়নি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি সাত থেকে আটবার অপেক্ষমাণ তালিকা দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। আসন ফাঁকা রেখেই শেষ করতে হয়েছে ভর্তি কার্যক্রম।
এবারের ভর্তি পরীক্ষার আগেও দেখা দিয়েছে একই সমস্যা। প্রথমে গুচ্ছ পদ্ধতিতে থাকতে আপত্তি জানায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি প্রক্রিয়ার সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রিতা ভর্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে- এমন দাবি করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে চায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শিক্ষক সমিতি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর তা (২৬ ফেব্রুয়ারি) জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে প্রথমবার গুচ্ছে বিভিন্ন রকম ত্রুটি দেখা দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার গুচ্ছে যাওয়ার পর আগের চেয়ে আরও বেশি ঝামেলা হয়। তৃতীয়বারে এর চেয়েও বেশি হতে পারে। আমরা গুচ্ছের পক্ষে বা বিপক্ষে নই, দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে।
এই অসন্তোষের পরই গুচ্ছ পদ্ধতি টিকিয়ে রাখতে আলোচনায় বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আলোচনা শেষে (২৭ ফেব্রুয়ারি) শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ছিল তারা সবাই আসছে। গত দুই বছরের পরীক্ষার আলোকে কিভাবে আরও ভালোভাবে পরীক্ষা আয়োজন করা যায় তা নিয়ে কথা হয়েছে।
এরপরও গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আবারও নিজস্ব ভর্তি পদ্ধতিতে ফিরতে একাধিকবার কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি অনুষদ থেকেও কর্তৃপক্ষের কাছে নিজস্ব পদ্ধতিতে ফেরার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
এদিকে বারবার দাবির পরও বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে থাকবে নাকি নিজস্ব ভর্তি পদ্ধতিতে ফিরবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কবে হবে সেটিও এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতি নির্ধারণে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশেষ একাডেমিক কাউন্সিল আহ্বান করার কথা থাকলেও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে গুচ্ছভুক্ত উপাচার্যদের মিটিংয়ের জন্য সেটি হয়নি। সেই মিটিংয়ে মার্চের শেষের দিকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগ্রহ জানান উপাচার্যরা। কিন্তু ২ মার্চ শিক্ষক সমিতির জরুরি মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা, মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থী না পাওয়া, ভর্তি কার্যক্রমে অনেক সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা গিয়েছে। এর সার্বিক প্রভাব পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরাও বিড়ম্বনায় পড়েছে।
অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, আমরা ২৭ ফেব্রুয়ারির মিটিংয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে এবং একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব ভর্তি পদ্ধতির বিষয়ে বলেছি। কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ একাডেমিক কাউন্সিল আয়োজনের জন্য স্মারকলিপি দিয়েছি। এখনও কোনো সাড়া পাইনি। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (১২ মার্চ) বিশেষ একাডেমিক কাউন্সিল সভা আয়োজন না করা হয় তাহলে আমরা মিটিং করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
এদিকে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতির পরিচালিত একটি জরিপে অংশ নেওয়া ৯৮ শতাংশ শিক্ষকই গুচ্ছ পদ্ধতিতে না থাকার পক্ষে মত দিয়েছেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. কবির হোসেন বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিড়ম্বনা বেশি। মাইগ্রেশন বেশি থাকায় শিক্ষকরাও এখন এ পদ্ধতি চাচ্ছেন না। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান না করলে গুণগত মানও ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। গুচ্ছের প্রতিবন্ধকতাগুলো সংস্কার করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে অতি দ্রুত শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে। তাদের ভোগান্তি লাঘব হয়।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের খরচ ও ভোগান্তি কমানোর লক্ষ্যে গুচ্ছভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়। শিক্ষকদের দায়িত্ব কোনো সমস্যা থাকলে সেটির সমাধান করা। সমাধান করা যাবে না এমন কোনো সমস্যা নেই।
গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
পিএস/জেএম