মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে যে শুল্ক আরোপ করেছেন সেখানে বাংলাদেশি পণ্যের ওপরও শুল্ক ৩৭ শতাংশ বাড়ছে। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্তে এখন সাধারণভাবে সব মিলিয়ে শুল্ক দাঁড়ালো ৫২ শতাংশ।
মার্কিন এই শুল্কের বড় প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞাপন
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ শনিবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসছেন। সেখানে শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলা নিয়ে আলোচনা হবে এবং একটি সমাধান আসতে পারে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আগামীকাল রোববার জরুরি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি পরবর্তী কৌশল ঠিক করা।
এ বৈঠক সশরীর অনুষ্ঠিত হবে না। জুম লিংকের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি এ বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় এ বৈঠক হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান।
ঈদের ছুটির মধ্যেও গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যাদের বৈঠকে অংশ নিতে অনুরোধ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পররাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে দেশের রফতানি বাজার বিশেষ করে পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ছাড়াও বর্ধিত ট্যারিফের কবলে পড়েছে আরও বহু দেশ। শুল্কের হার বাড়িয়ে ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ ও চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর আরোপ হয়েছে ২০ শতাংশ শুল্ক। এছাড়াও জাপানের ওপর ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫, মালয়েশিয়া ২৪ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ , শ্রীলঙ্কা ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩৬ শতাংশ ও কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের প্রধান দুই রফতানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রফতানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রফতানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে। নতুন করে উচ্চ মাত্রায় এই শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রফতানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে শুল্ক আরোপ হলো সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে মাত্রাটা আমাদের আশ্চর্য করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা হিসাব করেছে যে, প্রযোজ্য অতিরিক্ত শুল্ক হওয়ার কথা ৭৪ শতাংশ। ফলে এর অর্ধেক অর্থাৎ ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক তারা বসাচ্ছে। এটা যোগ হবে আমাদের মার্কিন বাজারে যে গড়ে ১৫ শতাংশ রফতানি শুল্ক আছে, তার সঙ্গে। অর্থাৎ, এটা দাঁড়াবে ৫২ শতাংশে। এটা যেকোনো বিচারে বড় মাত্রার আমদানি শুল্ক।
সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে পণ্যের মূল্য বাড়বে। এর ফলে মার্কিন ভোক্তারা তাদের চাহিদা কমিয়ে দেবে। যেমন, ধরেন, ১০ ডলালের একটা টি-শার্টের সঙ্গে আগের ১৫ শতাংশ শুল্ক যোগ করে দাঁড়াতো সাড়ে ১১ ডলারে। এখন আবার ৩৭ শতাংশ শুল্ক যোগ করলে দাঁড়াবে ১৫ ডলার। এই কারণে চাহিদার দিক থেকে তো একটা সংকোচন হবে। এতে বাংলাদেশের রফতানির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বর্তমানে আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তাতে আমরা সামনে আরও রফতানি বৃদ্ধির আশা করেছিলাম। আগে সবাই বলেছে, গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। আসলে আগে গড়ে ১৭ শতাংশ শুল্ক ছিল। ফলে বর্তমান অতিরিক্ত শুল্কের সঙ্গে এটা যোগ করলে হবে ৫৪ শতাংশ। নন কটনের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা আরও বাড়বে। এটা তো অবশ্যই আমাদের জন্য শঙ্কার। এই শুল্কের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাও কিন্তু কমে যাবে। তার মানে, সবারই রফতানি কমবে। এতে অর্থনীতির গতি কমবে। এটার প্রভাব কিন্তু সবাই ভোগ করবে।
জেবি