অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান। সত্তরোর্ধ্ব বয়স তাঁর। সময় পেলেই তিনি ছবিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। ছবিখানা দু’চোখ ভরে দেখেন। মাঝে মাঝে ৫০ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যান তিনি।
একাত্তরের এপ্রিল। যুদ্ধে যাবেন বলে হাফিজুর বাড়ি ছেড়েছিলেন। তখন তিনি যুবক। আরো কয়েক বন্ধুর সাথে মাগুরার মহম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকার রণাঙ্গনে নেমে পড়েন। বেশ কয়েকজন রাজাকার, আলবদরের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেন তারা। নয়টি মাস থেকেছেন আত্মগোপনে।
বিজ্ঞাপন
খুব কাছে গিয়েও বাড়িতে যেতে পারেননি তিনি।

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাফিজুর রহমান বলেন, এ অঞ্চলে আমি বড় হওয়ায় স্থানগুলো ছিলো আমার বেশ পরিচিত। এলাকার রাজাকারদের প্রতিরোধ করাই ছিলো আমাদের প্রধান কাজ। আমরা অনেক রাজাকার, আলবদরের কাছ থেকে তখন অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছি। তাদেরকে ধরে এনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েছি। সেই তথ্য কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি বড় অপারেশন করেছি আমরা। যার মধ্যে ভীষণ মনে পড়ে দুই সহোদর আহম্মদ, মহম্মদের শহীদ হওয়ার কথা। ১৯ নভেম্বর মহম্মদপুর মুসল্লী বাড়ির সামনে পুকুরের দুদিক থেকে গোলাম ইয়াকুব, কমল সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আমরা পরিকল্পিত আক্রমণ করেছিলাম। তখন সিও অফিস ছিলো রাজাকারদের ক্যাম্প। সেখান থেকে পাল্টা বৃষ্টির মতো গুলি চলছিলো। সবার সামনে ছিলো আহম্মদ, মহম্মদ। হঠাৎ গুলিতে মহম্মদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করতে ছোট ভাই আহম্মদ জাপটে ধরেন। এমন সময় আহম্মদকে লক্ষ করে গুলি চালানো হয়। তাদেরকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সেই দিনটির কথা কখনো ভুলতে পারিনি।
হাফিজুর রহমান এই ছবি প্রসঙ্গে বলেন, বিজয় অর্জনের পর আমরা একদিকে যেমন স্বজন হারানোর বেদনায় আক্রান্ত ছিলাম, অন্যদিকে একটা নতুন স্বপ্ন ছিলো চোখে। মহম্মদপুরে কোন স্টুডিও ছিলো না। তাই ভাবলাম অস্ত্র জমা দেওয়ার আগে মাগুরায় গিয়ে একটা ছবি তুলি। আমরা চার বন্ধু ‘খেয়ালী স্টুডিও’ থেকে ছবিটা তুলেছিলাম। ছবিতে আমার সাথে রয়েছেন সোহরাব হোসেন, আনোয়ার হোসেন মন্টু ও একেএম ফজলুল হক। এখন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কে কোথায় আছেন জানি না। জানি না ওদের কাছে ছবিটি আছে কিনা। কিন্তু, আমি সুযোগ পেলেই ছবিটি দেখি আর ফিরে যাই সেই হারানো দিনগুলোতে।
হাফিজুর রহমান বলেন, এই ছবিটি আমার জীবনের বড় একটি সম্পদ। আমার দুই কন্যা এটি নিয়ে গর্ব করে। আজ যদি সবাই তাদের সন্তানকে এরকম গল্প শোনাতে পারতো, তবে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা যেতো না। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানানো খুব জরুরি।
এইচই