বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

বৃদ্ধাশ্রমে মা

‘সাহরি খেতে মসজিদের মাইকে যখন ডাকে, তখন বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে’

মিলন মাহমুদ, কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০২:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

আমরা গরিব মানুষ। টেকা পয়সা না থাকলেও খুব আদর করেই ছেলে মানুষ করেছিলাম। বড় হওয়ার পর সেই ছাওয়ালের কাছেই বোঝা হয়ে গেছি। ৯ মাস গর্ভে ধারণ করে যে সন্তানকে পরম মমতায় লালন করে কর্মক্ষম করে তুলেছেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সেই ছেলে আর ছেলের বউয়ের কাছেই আমেনা হয়ে যান বোঝা। ভ্যানচালক ছেলে আয় করে পরিবারের সবার খরচ চালাতে পারলেও হাঁপিয়ে ওঠেন মায়ের ওষুধ কেনার সামান্য কিছু টাকা দিতে। বৃদ্ধ শাশুড়ির সামনে ভাত বেড়ে দিতে কষ্ট হয় একমাত্র ছেলের বউয়ের। অনেক শখ করে যে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বউমা ঘরে এনেছিলেন, বউমা আসার মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হয় আমেনা খাতুনকে।

আমেনা বলেন, এখানে আসার আগে অনেক দিনই না খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। তাই না খেয়ে থাকলে বা আধা পেট খেয়ে রোজা থাকলে বেশি কষ্ট লাগে না, কষ্ট লাগে সন্তান এবং পরিবারের কথা মনে পড়লে।


বিজ্ঞাপন


pic-02

যখন স্বামী বেঁচে ছিল, রোজা আসলে সবাই একসঙ্গে ইফতার করতে বসতাম। যাই থাকত স্বামী সন্তান নিয়ে ভাগ করে খেতাম। কিন্তু এখন সেসব সবই স্মৃতি। এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ক্যানাল পাড়া এলাকার ৭৫ বছরের আমেনা খাতুন। স্বামী মারা গেলেও উপার্জন করা ছেলে আছে। আছে ছেলের বউ এবং নাতি নাতনি, কিন্তু তারপরেও আমেনা খাতুনের দিন কাটে কুষ্টিয়া শহরের উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে বসেই মা একমাত্র সন্তানের জন্য চোখের পানি ফেলেন এবং তার দীর্ঘায়ুর জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন।

আমেনা খাতুন বলেন, শেষ বয়সে চাওয়া পাওয়ার তো কিছুই নেই। তবে সন্তানের কাছে থাকতে পারলে ভালো লাগতো, বেশি খারাপ লাগে রোজার সময় ঈদের দিনে। কিন্তু আমি থাকলে তাদের কষ্ট হয় তাই এখানেই পড়ে থাকি। ওরা তো ভালো থাকুক। নিঃসঙ্গ জীবনে আমেনার সংসার সন্তান বলতে এখন এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অন্যান্য বাসিন্দা। আর নিঃসঙ্গ জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বন বলতে সোনালি অতীতের স্মৃতিগুলো।

pic-01


বিজ্ঞাপন


যে মায়েদের শত ত্যাগ তিথিক্ষায় বেড়ে উঠেছে সন্তান, সন্তানদের জন্য সেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়েদেরই, এখন শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে বসেই পরিবার নিয়ে কাটানো সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণেই কাটছে কুষ্টিয়ার এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ৩০ জন মায়ের প্রতিটি মুহূর্ত। বৃদ্ধাশ্রমের জরাজীর্ণ বদ্ধ ঘরেই কোনো রকম মাথাগুজে কাটছে তাদের জীবন।

আরও পড়ুন

ছয় সন্তানের জনক ধনাঢ্য মোতালেব এখন ফুটপাতের বাসিন্দা

কথা হয় গত দশ বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ৭৭ বছর বয়সী আয়েশা খাতুনের সঙ্গে। আয়েশা খাতুনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার উদিবাড়ী এলাকার। এক সময় তার স্বামী সংসার সবই ছিল। ছিল না শুধু সন্তান। এর মধ্যেই বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যান আয়েশা খাতুনের স্বামী ইমতিয়াজ আলী। এর কিছুদিন পরেই নিজের দুই ভাই প্রতারণার মাধ্যমে তার নামে থাকা অল্প কিছু জমি লিখে নেন তাদের নামে। স্বামীর বাড়ির কোনো সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তাকে। তাই আয়েশার শেষ আশ্রয়স্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম। চোখের জলে এখানে বসেই দিন পার করছেন আয়েশা। বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও অনেকের আত্মীয় স্বজন দেখতে আসেন। কিন্তু আয়েশাকে দেখতে কেউ আসে না। আয়েশার খবর নিতে কেউ আসে না। এখন আর কষ্ট হয় না আয়েশার। আপন করে নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমের সবাইকে। তারাই এখন আয়েশার আপনজন।

আয়েশা বলেন, রোজা হোক বা ঈদ এক সময় খুব আনন্দে কাটিয়েছি। কিন্তু এখন আমার কেউ নেই। আছে বলতে এখানকার সবাই। তবে যখন সাহরি খাওয়ার জন্য মসজিদের মাইকে সবাইকে ডাকাডাকি করে, তখন বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। পরিবার পরিজনের কথা তখন হয়। শুধু আয়েশা বা আমেনা খাতুন নয়, কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকার সার্কিট হাউজের সামনে অবস্থিত এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মাহিরুন নেছা, তসলিমা খাতুন, পারুলা বেগমসহ সব মায়েরই আছে কোনো না কোনো দুঃস্বপ্ন ভরা ইতিহাস। যেগুলো তাদেরকে ডুকরে কাঁদতে বাধ্য করে।

pic-06

নীরবেই চোখের জলে কেটে যায় এই ৩০ জন মায়ের প্রতিটি মুহূর্ত। একসময় যে মায়েদের ছিল স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার, সেই মায়েদেরই এখন শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। বড় হয়েছেন সন্তানেরা, ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিজেদের সংসার নিয়ে। নিরাপদ আশ্রয়স্থল সেই মায়েদেরই প্রয়োজন ফুরিয়েছে সন্তানদের কাছে। তাই এক সাগর কষ্ট বুকে চেপে অতীতের সোনালি স্মৃতিচারণেই এই বৃদ্ধাশ্রমে কাটছে তাদের জীবন। সবকিছু ছেড়ে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই পেতে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই এই বৃদ্ধাশ্রমে ৩০ জন মায়ের বসবাস। যার প্রত্যেকেরই বয়স প্রায় ৬০ বছরের ওপরে। ৩০ জন মায়ের থাকার জন্য মাত্র ৪টি রুম। যেগুলো ভাড়া নেওয়া। পুরোনো জরাজীর্ণ ঘরে কোনো রকম ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয় তাদের। বাড়ির সামনে নেই কোনো হাঁটাচলার জায়গা। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ সুবিধা, পর্যাপ্ত শীত বস্ত্র বা পরিধানের কাপড়। খাদ্য, চিকিৎসাসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়েই কোনোরকম কাটছে এসব মায়েদের সময়।

একটি ব্যক্তি মালিকানার জমিতে তাদের একটু হাঁটা চলার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে সেই জমিটি ঘিরে সেখানে বহুতল ভবনের কাজ শুরু করেছেন জমির মালিক।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কেউ বসে আছেন, কেউ রান্নার জন্য লাকড়ি কেটে সাইজ করছে্ন। কেউ আবার বসে হাদিসের বই পড়ছেন। কয়েকজন প্রস্ততি নিচ্ছে্ন রান্না করার। স্যাঁতসেঁতে পুরোনো একটি বাড়ির দরজা জানালার ঠিক নেই। খসে পড়েছে দেওয়ালের পলেস্তারা। শুকনো মৌসুমেও সেখানে ঢোকার পথ ভিজে কাদা হয়ে আছে, পাশের বাড়ি থেকে আসা মোটরের পানিতে। এর মধ্যেই চলাফেরা করতে হয় বৃদ্ধ মায়েদের। সেখানেই কথা হয় কয়েকজনে সঙ্গে। তারা বলেন- এখানে আমরা নিজেদের সংসার গড়ে নিয়েছি। কিন্তু আমাদের মাথা গোঁজার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। বাড়িওয়ালারা মাঝে মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে। খুব শীত পড়েছে কিন্তু আমাদের সবার পর্যাপ্ত শীতের কাপড় নেউ। রাতে পায়ে ঠান্ডা লাগে কিন্তু মোজা নেই। তারপরে এখানকার দায়িত্বে যারা আছে তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আমাদের জন্য।

পারুলা বেগম বলেন, এখানে আমরা ৩০ জন অসহায় নারী থাকি। সঙ্গে এই জায়গার (প্রতিষ্ঠানের) আরও দু’জন। মোট ৩২ জন। এই ৩২ জনের তিন বেলার খাবার দেওয়া হয়। খুব ভালো খাবার না পেলেও যা পাই তা খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। 

pic-05

বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নানাবিধ সংকটে পড়েছেন বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কমে গেছে সাহায্য সহযোগিতার পরিমাণ। তাই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ৩০ জন মায়ের মোট ৯০ বেলার খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এসব অসহায় মায়েদের ভালোভাবে রাখতে সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বানসহ মায়েদের থাকার জন্য স্থায়ীভাবে এক টুকরো জমি প্রদানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আফরোজা ইসলাম।

আরও পড়ুন

প্যারালাইসিসে আক্রান্ত আশিকের চিকিৎসায় প্রয়োজন ৪ লাখ টাকা

এতগুলো মানুষের থাকাসহ প্রতিদিনে খাওয়ার যে খরচ তার জোগান আসে কোথা থেকে এমন প্রশ্নের জবাবে উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ইফতেখার হোসেন মিঠু বলেন, সব কিছুই আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন। কারণ বর্তমান সময় বাজারের যে ঊর্ধ্বগতি সেই সঙ্গে কমেছে সাহায্য সহযোগিতার পরিমাণ। তার পরেও অতিকষ্টে এখানকার মায়েদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। এখন এখানে আছেন ৩০ জন বৃদ্ধ মা। যারা প্রায় সবাই শারীরিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের স্থায়ী কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যেখানে আছি এখানে চারটি রুম ভাড়া করে থাকা হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে জায়গার পরিমাণ খুবই কম। কোথাও ছোট এক টুকরা সরকারি জায়গা এই প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান উদয় মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা।

এগিয়ে আসুক বিত্তবানরা শত কষ্টের মধ্যেও হাসি ফুটুক বৃদ্ধাশ্রমের মায়েদের মুখে। অতীতের সব স্মৃতিই হোক তাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। এমনটাই দাবি সংশ্লিষ্ট সবার।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর