বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

যশোরে রস হয় না ১৩ লাখ খেজুর গাছে

ইমরান হোসেন পিংকু, যশোর
প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

‘যশোরের যশ খেজুরের রস।’ এটি ছিল এ জেলার অন্যতম ঐতিহ্য। তবে জেলাতে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ, হারিয়ে যাচ্ছে গাছিও। গত পাঁচ বছরে খেজুর গাছ কমেছে ৫০ হাজার, গাছি কমেছে দেড় হাজার। গাছ এবং গাছি কমে যাওয়ায় ৫৫ লাখ লিটার খেজুর রস আহরণ কমে গেছে। ফলে ১ লাখ ৫০ হাজার কেজি গুড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’

16113124_1233272230124696_361512309077503933_o_(1)


বিজ্ঞাপন


কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, যশোরে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহ হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩টি গাছ থেকে। বাকি ১৩ লাখ গাছই রস সংগ্রহের বাইরে আছে। গাছ ছোট হওয়া ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়া এর প্রধান কারণ। এর বাইরে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে- বিগত পাঁচ বছরে খেজুর গাছ কমেছে ৫০ হাজার, আর গাছি কমেছে দেড় হাজার।

16113176_1233272536791332_8369970714240130153_o

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে যশোর জেলায় মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৫টি। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো। গাছি ছিল ৬ হাজার ৮৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয়েছে গড়ে ১২৫ কেজি এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।

২০২০ সালে মোট খেজুর গাছ ছিল ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫০টি। রস সংগ্রহ হয়েছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬০টি থেকে। গাছির সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৭২০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন ১২৫ লিটার এবং গাছ প্রতি গুড় উৎপাদন হয় ১২ কেজি।


বিজ্ঞাপন


15975075_1233282296790356_4584380075869336869_o

২০২১ সালে খেজুর গাছ কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৫টি। রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৩৫টি। গাছির সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৩০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হয় ১৩ কেজি।

২০২২ সালে মোট খেজুর গাছ আরও কমে হয় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি। আর রস সংগ্রহের গাছের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি। গাছির সংখ্যা হয় ৫ হাজার ১৫০ জন। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় ১২০ লিটার এবং গুড় উৎপাদন হয় ১২ কেজি।

16113000_1233272173458035_4506850570007713942_o

২০১৯ থেকে ২০২৩ এ ৫ বছরে গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৫০টি। এর মধ্যে রস সংগ্রহ হচ্ছে ৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩ টি গাছ থেকে। গাছির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫০ জনে। প্রতিটা গাছ থেকে রস উৎপাদন হয় গড়ে ১১৪ লিটার, প্রতিটি গাছ থেকে গুড় উৎপাদন হয় গড়ে ১০ কেজি। ৫ বছরে রসের উৎপাদন কমেছে ৫৫ লাখ লিটার। এসময়ে গুড়ের উৎপাদন কমেছে ১ লাখ ৫০ হাজার কেজি। 

জেলায় সবচেয়ে বেশি রস গুড় উৎপাদন হয় বাঘারপাড়া উপজেলায়। সেখানকার চিত্রও আশঙ্কাজনক। বাঘারপাড়া উপজেলায় পূর্ণ বয়স্ক খেজুর গাছ রয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার। রস দেওয়া গাছের সংখ্যা মাত্র ৪৫ হাজার। আর গাছির সংখ্যা ১ হাজার ৪৫ জন। রস উৎপাদন হয় ৫০ হাজার লিটার।

16177780_1233272280124691_4180495037250858372_o

যশোর সদরের লেবুতলার গাছি অলিয়ার রহমান বলেন, যত সমস্যা খেজুর গাছে। দু’বছর আগেও রাস্তা করার সময়ও অনেক খেজুর গাছ মারা পড়ে।

লাউখালী গ্রামের গাছি আব্দুস সালাম বলেন, আমার গ্রামের খেজুর গাছ প্রায় শেষ। আমি হাপানিয়া গ্রামের মাঠের খেজুর গাছ কাটি। মোট মাঠ কুড়িয়ে ১০০ গাছে রস হয়। আগের সেই বড় আর গাছ নেই। বড় গাছে রস বেশি হয়, মিষ্টিও হয়। বড় গাছ না থাকায় রসের পরিমাণ কম হচ্ছে। 

হাঁপানিয়া গ্রামের হাসান আলী বলেন, রাস্তার দু’পাশ দিয়ে কিছু গাছ আছে। তাছাড়া জমির আইলের ওপর এখন আর গাছ নেই। মাঠের সেই ৫০-৬০ বছর বয়েসের গাছ আর নেই। এ কারণে রসও অনেক কম।

16143422_1233272346791351_3291534306638310021_o

গাছি মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, গাছ কাটার মানুষ নেই। এখন সবাই গাছে উঠতে ভয় পায়। ২-৩ বছর আগে গাছ কাটার অভাবে মাঠে অনেক খেজুর গাছ পড়ে থাকতো। তবে বর্তমানে মাঠে খেজুর গাছ নেই বললেই হয়।

কৃষক রেজাউল করিম বলেন, খেজুর গাছের বাগান নষ্ট হয়েছে ইট ভাটার কারণে। ৮-১০ বছর আগে মাঠের প্রতিটা আইলে এবং জমির মাঝেও খেজুর গাছ ছিল। এখন আমাদের মাঠে ১০০ গাছও নেই।

বাঘারপাড়া উপজেলার শালবরাট গ্রামের সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে খেজুর গাছ কাটছি। আগে এক সময় ১০০ থেকে ১৫০টি গাছ কাটতাম। কিন্তু এখন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫টি গাছ কাটছি।

16143808_1233282303457022_5927534624270453714_o

তিনি আরও বলেন, এক ভাড় রস ৩০০ টাকা, এক কেজি পাটালি গুড় ৪০০ টাকা। তারপরও লোকজনের চাহিদা অনুসারে ঠিকমতো দিতে পারি না। গাছ বেশি হলে প্রতি মৌসুমে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।

উপজেলার বাগডাঙ্গা গ্রামের এরশাদ আলী বলেন, এক সময় অনেকগুলো গাছ কাটতাম। এখন ৮০টার মতো গাছ কাটি। তা থেকে যে রস হয় তা এলাকায় লোকজনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

khejur

যশোর জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, সাধারণত কৃষক খেজুর গাছের বাগান করতে চাই না। কারণ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে। আমরা এ জটিলতাকে আধুনিকায়ণ করতে প্রচেষ্টায় আছি। এদিকে গাছের মালিকরাও গাছ থেকে রস আহরণ করে না। অন্য মানুষ দিয়ে করায়। এ জন্য উভয়ের লাভের পরিমাণও কম হয়। যার কারণে গাছির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে পতিত জমিতে খেজুর গাছ লাগানোর জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। আবার সরকারিভাবেও গাছিদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এ প্রণোদনা চালু থাকলে কৃষকও উদ্বুদ্ধ হবে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দু’পাশ দিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং বন বিভাগ খেজুরের চারা রোপণ করে। এ চারা দেখা বা পরিচর্যার দায়িত্বও তাদের। গুড় উৎপাদন করে কৃষক যেহেতু কিছুটা লাভবান হচ্ছে। আশা করি গাছের পরিমাণও আর তেমন কমবে না। 

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন