কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ইতলা গ্রামে ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর ঘটেছিলো নৃশংস এক গণহত্যা। সেই দিন পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হত্যা করে কয়েকশ’ নিরীহ বাঙালিকে। যশোদল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেটে প্রাণ হারায় ৩৬৫ জন সাধারণ মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি গ্রাম। ৪৯ বছর আগের দিনটির কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠেন এলাকার প্রবীণরা। কিন্তু এই গণহত্যার বিচার পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। জোটেনি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কিংবা মর্যাদায়ও।
জেলায় আরও ২৫টি গণকবর থাকলেও এক জায়গায় এত মানুষকে হত্যা ছিল নজিরবিহীন নৃশংসতা। সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা মনে হলে এলাকার প্রবীণ লোকজন আজও শিউরে উঠেন। গণহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তাঁরা। স্বজন হারানোর কষ্ট এতদিন পরেও তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁদের।
বিজ্ঞাপন
শহরের আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আজিজুল ইসলাম, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, সবগুলো দাত পড়ে গেছে ঠিকভাবে বলতে পারেন না কথা তবুও এই দিনটি আসলে বসে এসে বসে থাকেন স্মৃতিসৌধটির পাশে। ঐদিন তিনি চাচা, চাচাতো ভাইসহ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন স্বজন, চোখের সামনে দেখেছেন এই নারকীয় হত্যাযোগ্য। ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আত্বীয়-স্বজন হারানোর বেদনা অত্যান্ত মর্মান্তিক। আমরা তা বুঝি। যাদের প্ররোচনায় এই নারকীয় হত্যাকান্ডটি হয়েছে অর্থাৎ স্থানীয় রাজাকার, তাদের বিচার আজ অবদি হয়নি। এটি এলাকাবাসী একটি দাবী যেনো তাদের বিচারটা অন্তত হয়।
ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথের পাশেই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বরইতলা গ্রামের অবস্থান। একাত্তরের ১৩ অক্টোবর দুপুরে পাক সেনাদের একটি ট্রেন এসে থামে এ গ্রামের কাছে। পাকিস্তানি সেনা ও রাজকাররা ট্রেন থেকে নেমে চলে যায় পাশের দামপাড়া গ্রামে। সেখানে বেশ কয়েকটি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে তারা। পরে দামপাড়া, বড়ইতলা, চিকনিরচর, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুরসহ পুরো এলাকার ভীতসন্ত্রস্ত লোকজনকে ধরে এনে রেল লাইনের পাশে জড়ো করা হয়। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদলের এক সৈন্য দলছুট হয়ে পড়ে। তখন রাজাকাররা গুজব ছড়িয়ে দেয়, ওই সৈন্যকে অপহরণ করে হত্যা করেছে গ্রামবাসী। এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করে রেল লাইনের কাছে জড়ো করা গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় পাক সেনারা। গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বহু মানুষকে। ঘটনাস্থলে প্রায় শতাধিক গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। অহত অবস্থায় পরে মারা যায় বাকিরা। সব মিলিয়ে ৩৬৫জন নিরীহ গ্রামবাসী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সেদিনের হামলায়।
বড়ইতলা রেললাইনের পাশেই থাকেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদিন। ঢাকা মেইলকে সেদিনের ভয়াল বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘তিনটার দিকে যখন পাক সেনারা চলে যাবে, তখন স্থানীয় এক রাজাকার এসে বলে আমাদের একজনকে পাওয়া যাচ্ছে। তখনি খেপে যায় মিলিটারিরা এবং সমস্থ মানুষকে এক সাথে জরো করে প্রথমে শাবল পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে এবং শেষে ব্রাশ ফায়ার করে মারে।
একই এলাকার আরেক শহীদ সন্তান মোর্সেদ তিনি বলেন, ‘১৩ অক্টোবর আমার বাবাকে মেরে ফেলেছি পাকবাহিনী। আমার বয়স তখন ৬মাস। বড় বোনের কাছে শুনেছি বুকে গুলি করেছিল সেই গুলি বের হয় পিঠ দিয়ে সাথে সাথেই তিনি মারা যান। বাবাকে সেদিন কবর দেওয়ার মতও কেউ ছিল না, ফলে বাবার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল নরসুন্দা নদীতে। বাবাকে তো নয়ই বাবার কবরটা পর্যন্ত দেখার ভাগ্য হয়নি আমার।’
বিজ্ঞাপন
এলাকার এমন কোনো পরিবার নেই, যারা ওই গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। স্বজন হারানোর পাশাপাশি লুণ্ঠিত হয় সহায়-সম্পদ। পাক সেনাদের লালসার শিকার হয় নারীরাও। স্বজন ও সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব অনেক পরিবার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের পুণর্বাসনেও নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। এলাকাবাসী নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া, একইসঙ্গে স্থানীয় রাজাকারদের বিচার দাবি করেছেন।
বর্তমানে বড়ইতলা স্মৃতিসৌধটি যে জায়গার উপর দাড়িয়ে আছে সেই জায়গাটি দান করেছিলেন মো. মর্তুজ আলী। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, মিলিটারিরা যখন চলে যায় এলাকার যে কয়জন বেচে ছিল এসে দেখে মানুষ একজনের উপড় একজন কলাগাছের মত পড়ে আছে। আর রক্ত ড্রেন দিয়ে গড়াইয়া যাইতাছে। পরবর্তীতে বহুবছর পর যখন সিন্ধান্ত হলো এখানে স্মৃতিমিনার তৈরি হবে তখন এই জায়গাটা আমি দান করি। তবে দুঃখ ১৩তারিখ আইলে মানুষজন একটু আইয়ে বাকি কোন দিন একটা খোজখবরও লয় না কেউ।
একই এলাকার ইদ্রিস মিয়া, তিনি বলেন, ১৩তারিখ পাকবাহিনী আমার আত্বীস্বজন ৮জনকে ধরে নিয়া আসে। আমার বাপ,চাচা, দাদা, চাচাতো ভাই চারজনকে সাথে সাথে মেরে ফেলে, আর চারজন পরবর্তী ছিদিনের মাঝেই মারা যায়। আমাদের যে এত ক্ষয়ক্ষতি হইয়ে কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইছি না। এমনকি তাগো শহীদের মর্যদা পর্যন্ত দেয় নাই।
সেদিনের বর্বরতার চিহ্ন বহন করছে এই স্মৃতিস্তম্ভটি। এটিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। নিহতদের নাম লেখা স্তম্ভ থেকে অনেক নাম মুছে গেছে এরইমধ্যে। ১৩ অক্টোবর এলেই কেবল কিছু আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে দিনটি পার করে প্রশাসন। তবে শীগ্রই শহীদদের স্মৃতিতে একটি পাঠাগার নির্মান করা হবে বলে জানান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আলী সিদ্দিকী।
তিনি আরও বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হওক এবং শহীদরা মর্যাদা পাক সেটা সবাই চায়। তবে এলাকাবাসী যদি কোনো উদ্দেশ্য নেয় তবে সবসময় প্রশাসন তাদের সঙ্গে থাকবে।
স্থানীয়রা বলছেন, বরইতলা গ্রামের পাশেই বীর দামপাড়া গ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি। এ প্রতিহিংসায় এলাকটিকে নিশানা করে ওইদিন রাজকারদের ইন্ধন ও সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় সেখানে।
প্রতিনিধি/ এজে