০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৪:২০ পিএম
আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা উজাইর (আ.)। যিনি আল্লাহর ইচ্ছায় এক শ বছর মৃত অবস্থায় ছিলেন। এরপর পুনরায় জীবিত হন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। সুরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে- ‘অথবা সে ব্যক্তির মতো, যে কোনো জনপদ অতিক্রম করছিল, যা তার ছাদের ওপর বিধ্বস্ত ছিল। সে বলল, আল্লাহ একে কিভাবে জীবিত করবেন মরে যাওয়ার পর? অতঃপর আল্লাহ তাকে এক শ বছর মৃত রাখলেন।
এরপর তাকে পুনর্জীবিত করলেন। বললেন, ‘তুমি কতকাল অবস্থান করেছ?’ সে বলল, ‘আমি এক দিন অথবা দিনের কিছু সময় অবস্থান করেছি।’ তিনি বললেন, ‘বরং তুমি এক শ বছর অবস্থান করেছ। সুতরাং তুমি তোমার খাবার ও পানীয়ের দিকে তাকাও, সেটি পরিবর্তিত হয়নি এবং তুমি তাকাও তোমার গাধার দিকে, আর যাতে আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে পারি এবং তুমি তাকাও হাড়গুলোর দিকে, কিভাবে আমি তা সংযুক্ত করি, অতঃপর তাকে আবৃত করি গোশত দ্বারা।’ পরে যখন তার কাছে স্পষ্ট হলো, তখন সে বলল, ‘আমি জানি, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ (সুরা বাকারা: ২৫৯)
আয়াতের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইবনে কাসির (রহ.)
আয়াতে উজাইর (আ.)-এর কথা উল্লেখ না থাকলেও প্রসিদ্ধ মতে তাঁর সম্পর্কেই এ আয়াত নাজিল হয়েছে। বুখতানাসসার নামের এক জালিম শাসক ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাসে গণহত্যা চালায় এবং পুরো বসতি ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। একজন মানুষও জীবিত ছাড়েনি। সেই বিরান জেরুজালেমের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন উজাইর (আ.)। তখন জনশূন্য বসতির এই ধ্বংসস্তূপ দেখে তাঁর মনে কৌতূহল জেগেছিল যে এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া জনপদকে কেমন করে মহান আল্লাহ হাশরের ময়দানে ফের জীবিত করবেন। তখন আল্লাহ তাঁকেই মৃত্যু দেন এবং সেই স্থানে রেখে দেন।
এরপর কেটে যায় এক শ বছর। শহরটি আবার নতুন প্রাণে সজীব হয়ে ওঠে। বনি ইসরাইল শহরে ফিরে এসে নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করে। তখন আল্লাহ তাআলা উজাইর (আ.)-কে ফের জীবিত করেন। প্রথমে তাঁর দুই চোখে প্রাণ ফিরিয়ে দেন, যাতে দেহের বাকি অংশ কীভাবে ফের প্রাণ ফিরে পাচ্ছে, তা দেখে তিনি শিখতে পারেন।
পুরো দেহে প্রাণ ফিরলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁকে প্রশ্ন শুরু করেন—কত দিন এভাবে ছিলে। যেহেতু দিনের শুরুতেই মারা গিয়েছিলেন এবং এখনো দিনের কিছু অংশ বাকি আছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর উত্তর ছিল—একদিন বা তারও কম সময়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর দাবি নাকচ করে দিয়ে বললেন—এক শ বছর পর তোমাকে জীবিত করেছি। সুতরাং পরকালেও এভাবেই জীবিত করা হবে।
উজাইর (আ.)-এর চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হওয়ার আগেই আল্লাহ দলিল উপস্থাপন করে দিলেন। বললেন, দেখো, তোমার দেহের মতো এখানে যে আঙুর, তীনফল ও শরবত ছিল, তা হুবহুই রেখে দিয়েছি, এগুলোর স্বাদ-গন্ধে কোনো পরিবর্তন আনিনি, তবে তোমার যে গাধাটি ছিল, তা দেখো পচে-গলে একাকার হয়ে গেছে এবং কীভাবে তা আমি ফের জীবিত করছি; দেখো, কীভাবে হাড়গুলো জোড়া লাগিয়ে মাংসের প্রলেপ দিয়ে দিচ্ছি। চোখের সামনে এমন আশ্চর্য ঘটনা দেখে উজাইর (আ.)-এর কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহ সবকিছুই পারেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১ / ৬৮৭-৬৮৯)
এ ঘটনা সম্পর্কে ইসহাক ইবনে বিশর...আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে উজাইর (আ.) ছিলেন একজন জ্ঞানী ও পুণ্যবান লোক। একবার তিনি তাঁর ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচা দেখার জন্য ঘর থেকে বের হন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে দ্বিপ্রহরের সময় একটা বিধ্বস্ত বাড়িতে বিশ্রাম নেন।
তাঁর বাহন গাধার পিঠ থেকে নিচে অবতরণ করেন। তাঁর সঙ্গে একটি ঝুড়িতে ছিল ডুমুর এবং অন্য একটি ঝুড়িতে ছিল আঙুর। খাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি একটি পেয়ালায় আঙুর নিংড়ে রস বের করে এবং শুকনো রুটি তাতে ভিজিয়ে রাখেন। তিনি রুটিগুলো রসের ভেতর ভালোভাবে ভিজলে খাবেন বলে কিছু সময় বিশ্রাম করতে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি বিধ্বস্ত ঘরগুলোর দিকে খেয়াল করেন, যার অধিবাসীরা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে কিছু হাড় দেখতে পেয়ে তিনি মনে মনে ভাবেন, ‘মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ এগুলোকে কিভাবে জীবিত করবেন?’
মহান আল্লাহ যে মৃত্যুর পর জীবিত করতে সক্ষম এতে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। শুধু কৌতূহল ও বিস্ময় থেকে তিনি এমনটা ভেবেছিলেন। মহান আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশতা পাঠিয়ে দেন এবং তাঁর রুহ কবজ করিয়ে নেন। তিনি তাঁকে এক শ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় রেখে দেন। এক শ বছর পূর্ণ হলে আল্লাহ তাআলা উজাইর (আ.)-এর কাছে ফেরেশতা পাঠান। ফেরেশতা এসে প্রথম উজাইর (আ.)-এর অন্তর ও চোখগুলো জীবিত করেন, যাতে তিনি মহান আল্লাহ কর্তৃক মৃতকে জীবিত করার প্রক্রিয়াগুলো স্বচক্ষে দেখতে পান এবং অন্তরের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারেন।
এরপর ফেরেশতা তাঁর বিক্ষিপ্ত হাড়গুলো একত্র করে তাতে গোশত লাগান, চুল-পশম ইত্যাদি যথাস্থানে সংযুক্ত করেন। চামড়া দিয়ে সমস্ত শরীর আবৃত করেন। সব শেষে তাঁর মধ্যে রুহ প্রবেশ করান। মহান আল্লাহর কুদরতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াই উজাইর (আ.) উপলব্ধি করছিলেন। উজাইর (আ.) উঠে বসলেন। আপনি এ অবস্থায় কত দিন ছিলেন, তিনি উত্তর দিলেন-এক দিন বা এক দিনেরও কম। ফেরেশতা জানালেন, না; বরং আপনি এক শ বছর এভাবে অবস্থান করেছেন। আপনার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ করুন! দুটির একটিও নষ্ট হয়নি। সব কিছু একেবারে টাটকা ছিল। উজাইর (আ.) ফেরেশতার কথায় কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যান। তাই ফেরেশতা তাঁকে বলেন, আপনি আমার কথায় সন্দেহ করছেন, তাহলে আপনার গাধাটির প্রতি লক্ষ করুন। উজাইর (আ.) লক্ষ্য করে দেখেন, তাঁর গাধাটি পচে-গলে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হাড়গুলো পুরনো হয়ে যত্রতত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। অতঃপর ফেরেশতা হাড়গুলোকে আহ্বান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাড়গুলো চতুর্দিক থেকে এসে একত্রিত হয়ে গেল এবং ফেরেশতা সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলেন। তারপর ফেরেশতা উক্ত কঙ্কালে রগ, শিরা-উপশিরা সংযোজন করেছেন। গোশত দ্বারা আচ্ছাদিত করে তাকে চামড়া ও পশম দ্বারা আবৃত করেন। সব শেষে তার মধ্যে রুহ প্রবেশ করান। ফলে গাধাটি মাথা ও কান খাড়া করে দাঁড়াল এবং কেয়ামত আরম্ভ হয়েছে ভেবে চিৎকার করতে লাগল। এভাবেই মহান আল্লাহ উজাইর (আ.)-কে দুনিয়াতেই মৃত্যু দেন ১০০ বছরের জন্য। এরপর তাঁকে দেখিয়ে দিলেন মৃতদেহকে জীবিত করার প্রক্রিয়া। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
উজাইর (আ.) কি নবী ছিলেন
উজাইর (আ.) একজন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন এটুকুতে কারও দ্বিমত নেই। নবী ছিলেন কি না তা নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রসিদ্ধ মতে, তিনি নবী ছিলেন। ইবনে কাসির (রহ.) এই মত গ্রহণ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)
তবে অনেকের মতে, তিনি যে নবী ছিলেন, এর পক্ষে কোরআন-হাদিসে কোনো দলিল পাওয়া যায় না। বরং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (স.) বলেছেন, ‘আমি জানি না তুব্বা বাদশাহ অভিশপ্ত, নাকি নয়। আমি জানি না উজাইর নবী; নাকি নয়।’ তাই তাঁকে নবী বলা উচিত হবে না। তবে এই হাদিসের সনদ অনেকেই দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। যাই হোক, এ ঘটনার শিক্ষার সঙ্গে তাঁর নবী হওয়া-না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
উজাইর (আ.)-কে ১০০ বছর মৃত রাখার ঘটনায় শিক্ষা
ঘটনার শিক্ষা হলো- সময়ের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহরই হাতে। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। পরকালে তিনি সব সৃষ্টিকে ফের জীবিত করে কর্মফল দেবেন। তাই সময় থাকতে পরকালের প্রস্তুতি নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। একটি বছর ফুরিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হলো, এই বছরটিও একদিন ফুরিয়ে যাবে। এভাবেই আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাই মৃত্যুর পরের জীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এখনই। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন চোখ স্থির হয়ে যাবে, চাঁদ আলো হারাবে, সূর্য ও চাঁদকে এক জায়গায় করা হবে, সেদিন মানুষ বলবে—পালাব কোথায়?’ (সুরা কিয়ামা: ৭-১০)