images

সারাদেশ

চা পাথর আর কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রাচীন মোহ পঞ্চগড়ে

জেলা প্রতিনিধি

১৪ জুন ২০২২, ০৯:০২ এএম

দেশের সর্বউত্তরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত পঞ্চগড় জেলা। সীমান্তবর্তী এ জেলার তিনদিকে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান। হিমালয়ের নিকটবর্তী এ জনপদের অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত এই জেলা। 
 
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন ও মধ্য যুগে এ অঞ্চলের পাশেই ছিল মগধ, মিথিলা, গৌর, ভূটান, নেপাল ও ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্ত। এ জেলার ভূ-খন্ডটি পর্যায়ক্রমে শাসিত প্রার্গ-জ্যোতিষ, কামরুপ, কামতা, কুচবিহার, গৌর রাজাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। খ্রিস্টাব্দ ২য়-৩য় শতকের মধ্যে রাজা শালিবাহন, রাজা পৃথু এবং রাজা জল্লেশ এই পঞ্চগড়ের শালবাহান ও ভিতরগর এলাকায় তাদের সামাজ্য অঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন।

আরও পড়ুন: কালো ধানে বাজিমাত তেঁতুলিয়ার সাদেকুলের

জেলাটির তিনদিকে ১৮৩ মাইল বেষ্টিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল রয়েছে। উত্তরে ভারতের দার্জিলিং জলপাইগুড়ি জেলা, উত্তর পূর্ব ও পূর্বে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা ও এবং পশ্চিমে ভারতের পূর্ণিয়া উত্তর দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। করোতোয়া, মহানন্দা, ডাহুক, বেরং, তালমা, ভাঙ্গা এবং চাওয়াই নদীসহ ৩২টি ছোট বড় নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি পঞ্চগড়ে রয়েছে সমতলের চা বাগান।

tea panchgarh
সমতলের চা বাগান

নামকরণ: 
এ জেলার নামকরণে এক অনন্য ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন মতও প্রচলিত রয়েছে। জানা যায়, এ অঞ্চলটি অতি প্রাচীনকালে পুন্ড্রনগর রাজ্যের অন্তর্গত পঞ্ছনগরী নামে একটি অঞ্চল ছিল। কালক্রমে যা পঞ্চনগরী থেকে পঞ্চগড় নামে আত্মপ্রকাশ করে। পাঁচগড়— যেমন, ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড়ের থেকে পঞ্চগড় জেলার নামকরণ করা হয় পঞ্চগড়।

পর্যটন-শিল্প-সম্ভাবনার জেলা:
জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ বিভক্তকারী নদীর তীরে টিলার ওপর অবস্থিত ঐতিহাসিক ডাকবাংলো এবং তার পাশে রয়েছে পিকনিক স্পট। ডাকবাংলোটির নির্মাণশৈলী অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। এটি কুচবিহারের রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ডাকবাংলো এবং পিকনিক স্পটটি টিলার উপর প্রতিষ্ঠিত এখান থেকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় বাংলাদেশ ও ভারতের অপরুপ সৌন্দর্য।

আরও পড়ুন: তেঁতুলিয়ায় চায়ের জমিনে আমের বিজয়ধ্বনি

চা চাষের অঞ্চল হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছে জেলাটি। পঞ্চগড়ে চা বাগান ছাড়াও রয়েছে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, পিকনিক কর্নার, শিশুপার্ক ও আনন্দধারা পার্ক, সীমান্তবেষ্টিত ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার সার্চলাইট, নদী মহানন্দা, সবজি গ্রাম, পাথর-শিল্প। অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বাড়ছে এই জেলার কদর।
  
এছাড়া দেশের একমাত্র চারদেশীয় (বাংলাদেশ,ভারত, নেপাল ও ভুটান) বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি ব্যবসা-বানিজ্যের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

kanchanjhongha
এপারে পঞ্চগড় ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহ | ছবি: সংগৃহীত

এ বন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, ভূটানের ৬৪ কিলোমিটার, মাউন্ট এভারেস্ট ৭৫ কিলোমিটার, দার্জিলিং ৫৪ কিলোমিটার, চীন ২০০ কিলোমিটার ও শিলিগুড়ি ৮ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট দেখতে পর্যটকদের ভীড় লেগেই থাকে। 

এপারে পঞ্চগড় ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহ:
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ দৃশ্য। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে শীতের সকালে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে দাঁড়িয়ে উত্তরের মেঘমুক্ত আকাশে তাকালেই চোখে দেখা যায় সোনা রোদে ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই মায়াবী দৃশ্য দেখতে প্রতিবছরই হাজারো পর্যটক তেঁতুলিয়ায় আসেন।

আরও পড়ুন: সবুজপাতার হাতছানি: পঞ্চগড়ে চা শিল্পে অপার সম্ভাবনা

ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল:
এটি গতানুগতিক কোনো স্কুল নয়। চা বাগানের পাশে খোলা ময়দানে আকশের নিচে ক্ষুদ্র চা চাষিদের নিয়ে আয়োজিত একটি ছাদ ও দেয়াল বিহীন স্কুল। জানা যায়, প্রতিবেশি দেশ ভারতের দার্জিলিং সীমান্ত থাকায় ওখানে যদি চায়ের চাষ হয় তাহলে এখানে কেন হবে না। এই ধারণা নিয়েই সমতলে শুরু হয় চা চাষ। আর এসব চাষিদের দোরগোড়ায় বিভিন্ন ধরনের সেবা পৌঁছে দিতে তেঁতুলিয়ার চায়ের গ্রাম বলে খ্যাত পেদিয়াগজ এলাকায় স্কুলটি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে এই এলাকায় প্রচুর মানুষ চায়ের গ্রাম দেখতে আসে। ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

camelia school
ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল | ছবি: সংগৃহীত

পাথরের জাদুঘর:
দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর পঞ্চগড়ে। জেলার সরকারি মহিলা কলেজের একটি কক্ষে ১৯৯৭ সালে রকস্ মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক। এ মিউজিয়ামে রয়েছে হাজার বছরের নানান আকৃতির পাথরসহ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্যেকটি পাথরের পাশে লেখা রয়েছে কোথা থেকে এবং কারা সংগ্রহ করেছেন এ মূল্যবান প্রত্নসম্পদ। এখানে রয়েছে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা, নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, কাঁচবালি, খনিজবালি, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শিলাসহ আরও অনেক প্রত্নসম্পদ।

আরও পড়ুন: সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায় তেঁতুলিয়ার কয়েক গ্রামের মেয়েরা

মির্জাপুর শাহী মসজিদ:
মির্জাপুর শাহী মসজিদটি পঞ্চগড়ের অটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত। ১৬৫৬ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে জানা যায়। তবে এটি কে নির্মাণ করেছিলেন, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন, মির্জাপুর গ্রামেরই এক বাসিন্দা এটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার কারো মতে দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মসজিদটির মধ্যবর্তী দরজার উপরে একটি ফলক রয়েছে, যেখানে ফার্সি ভাষায় এর নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য লেখা আছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, মোঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের গায়ে টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশা খোদাই করা আছে। যার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো সাদৃশ্য নেই। নির্মাণ শৈলীর নিপুণতা, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও তিনটি গম্বুজ এই মসজিদের মূল আকর্ষণ। মসজিদটি এখন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আয়ত্তে রয়েছে।

আরও পড়ুন: বগুড়ার মৃৎশিল্প টিকিয়ে রেখেছে দই

বারো আউলিয়ার মাজার:
জানা যায়, আটোয়ারী উপজেলার বারো আউলিয়া গ্রামে সুলতানি আমলে ১২ জন আউলিয়ার আগমন ঘটেছিল। তারা বারো আউলিয়া গ্রামে (বর্তমান) দ্বীন প্রচারের কাজ শুরু করেন এবং এখানেই তারা ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে বারো আউলিয়াগণের সমাধিকে কেন্দ্র করে একটি মাজার গড়ে ওঠে, যা বারো আউলিয়ার মাজার নামে পরিচিত। এ মাজারকে ঘিরে নানান লোককথা প্রচলিত রয়েছে। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বারো আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ওরসের অয়োজন করা হয়। এই সময় দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ মাজার জিয়ারতের জন্য ছুটে আসেন।

shahi mosque
মির্জাপুর শাহী মসজিদ

গোলকধাম মন্দির:
গোলকধাম মন্দিরটি দেবীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত শালডাংগা ইউনিয়নের শালডাংগা গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। সুন্দর কারুকার্যময় এই মন্দিরটির গায়ের শিলালিপি অনুযায়ী জানা যায়, এটি ১৮৪৬ সালে নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি মূলত গোলক কৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই মন্দিরের নামেও তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। গোলকধাম মন্দিরটি ছয় কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। এর  স্থাপত্য কৌশল গ্রীক পদ্ধতির অনুরূপ, যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

আরও পড়ুন: মৌচাষে ‘স্বর্গবাস’ আসাদের

বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির:
বদেশ্বরী মন্দিরটি বোদা উপজেলায় অবস্থিত। অনেকে বলেন, এই মন্দিরের বদেশ্বরী নাম থেকেই এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। আবার কিছু মানুষের ধারণা, এই অঞ্চলে এক সময় অনেক কাদা হতো আর কাদার সমার্থক শব্দ বোদ থেকেই এসেছে বোদা উপজেলার নাম। হিন্দু পুরাণের স্কন্দ অনুযায়ী, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে দেবী দুর্গার দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে দুইটি খণ্ড পড়েছিল বাংলাদেশে। যার একটি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডুতে আর অন্যটি পড়েছিল পঞ্চগড় জেলার বদেশ্বরীতে। সেখানেই চারশ বা পাঁচশ বছর পূর্বে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। বদেশ্বরীতে অবস্থিত প্রাচীন এই মন্দিরটিই বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির। মূলত উপমহাদেশের যেখানে যেখানে দেবী দুর্গার শরীরের খণ্ড পড়েছিল সেই জায়গাটিকে পীঠ বলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলানো একটি চার্টে এরকম ৫১টি পীঠ স্থানের উল্লেখ রয়েছে। বদেশ্বরীর এই পীঠে এখনো সংরক্ষিত আছে দেবী দুর্গার গোড়ালি।

rocx museum
পাথরের জাদুঘর

ভিতরগড় দুর্গনগরী:
ভিতরগড় মধ্যযুগের একটি বিশাল দুর্গনগরী। এটি প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা বাংলাদেশের সব থেকে বড় দুর্গনগরী। এর কিছু অংশ বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে আর কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত।
ভিতরগড় দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে। এ প্রত্নস্থলসমূহ খালপাড়া, প্রধানপাড়া, ছোট কামাত, চুমানুপাড়া, কমলাপাড়া, সেনপাড়া, পেশকার পাড়া, জমাদার পাড়া, বড় কামাত, মেহনা ভিটা ও সিপাহি পাড়া গ্রাম জুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে দীঘি, মন্দির, রাজবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া এখানে বিভিন্ন আসবাবপত্রসহ দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এর নির্মাণকাল সম্পর্কে অনুমান করেন যে, এটি প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: ১২ মিনিট বেশি রোজা রাখেন পঞ্চগড়বাসী

স্বচ্ছপানির মহারাজার দীঘি:
পঞ্চগড়ের মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এক সময় পৃথু রাজের রাজপ্রাসাদ ছিল। এর পাশেই এখনো বর্তমান রয়েছে একটি দীঘি, যা মহারাজার দীঘি নামে পরিচিত। পৃথু রাজার খননকৃত এই ‘মহারাজার দীঘিথটি বিশাল আয়তনের একটি পুকুর বা জলাশয়। পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০x৪০০ গজ। অধিক গভীরতার কারণে দীঘিটির পানি অনেক স্বচ্ছ। শোনা যায়, পৃথু রাজা এক দিন কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণীর লোকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন। তখন তিনি ‘ধর্মনাশের ভয়ে’ ওই দীঘিতে আত্মহনন করেছিলেন। প্রতিবছর নববর্ষের সময় মহারাজার দীঘির পাড়ে মেলা বসে।

প্রতিনিধি/এএ