সোমবার, ৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

বগুড়ার মৃৎশিল্প টিকিয়ে রেখেছে দই

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২২, ১১:৫৮ এএম

শেয়ার করুন:

প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্যের ভিড়ে কমে গেছে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কদর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবু বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে এখনও অনেকেই কাজ করছেন মৃৎশিল্পী হিসেবে। 

বগুড়া সদর উপজেলায় শেখেরকোলার পালপাড়া এমনই একটি এলাকা। যেখানে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সারি, সারি মাটির ঢিপি আর রাস্তার দুই ধার থেকে শুরু করে ফাঁকা জায়গায় মাটির তৈরি তৈজসপত্র শুকানোর কাজে ব্যস্ত নারী-পুরুষ। বাপ দাদার আমল থেকে শত বছরের পুরোনো এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছে কয়েকশ’ পরিবার। তাদের বাড়ির বৃদ্ধ থেকে শিশু-কিশোররাও এ কাজের সাথে জড়িত। এছাড়া দইয়ের জন্য বিখ্যাত শহর বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে মৃৎশিল্পীরা দইয়ের পাত্র তৈরি করছেন। জেলার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে এসব দইয়ের পাত্র।


বিজ্ঞাপন


মাটির যেকোনো পাত্র তৈরিতে কাদা প্রস্তুত করতে হয় প্রথমে। এরপর নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য প্রস্তুতকৃত কাদা গোল্লা বা চাকা তৈরি  করতে হয়। পরে তা চাকার মাঝখানে রাখা হয়। চাকা ঘুরতে ঘুরতে মৃৎশিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় তৈজসপত্র। এরপর তা শুকিয়ে স্তুপ আকারে সাজিয়ে চুল্লিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পোড়ানোর পর পণ্যের গায়ে রঙ করতে হয়। বিলুপ্তপ্রায় এই পেশাটি বেশ যত্নের সাথে আগলে রেখেছেন মৃৎশিল্পীরা।

সরেজমিনে শেখেরকোলার পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মৃৎশিল্পীদের কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। বাড়ির উঠানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাটির তৈরি বাহারি পণ্য।
Matir patroগ্রামে পা দিতেই চেখে পড়লো একজন মৃৎশিল্পী মাথায় মাথাল দিয়ে রোদে বসে দইয়ের হাঁড়িতে (দই রাখার বিশেষ পাত্র) রং করছেন। কথা হয় অন্যকুল চন্দ্র পাল নামের ওই মৃৎশিল্পীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাপ, দাদার আদি পেশা এটি। নিজে এই পেশায় যুক্ত আছেন প্রায় ত্রিশবছর হলো। তার সংসারে এক ছেলে, এক মেয়ে। এই কাজ করে সংসার চালান অন্যকুল। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করান। 

তিনি বলেন, ‘আমি এই পেশায় যুক্ত আছি, কিন্তু আমি চাই আমার সন্তানরা লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করুক। এই পেশার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের বংশের রক্ত, তাই পেশাটি ছাড়তে পারি না। পরিশ্রম করতে হয় প্রচুর। রোদের মধ্যে বসে কাজ করতে হয়।’

আগে তিনি তৈরি করতেন মাটির হাঁড়ি, থালা, বাটি, কলসি, ঢাকনাসহ অনেক কিছু। কিন্তু এখন শুধু দইয়ের হাঁড়ি তৈরি করেন। দইয়ের পাত্র প্রতি পিস পাইকারি বিক্রি করেন ৬-৭ টাকা করে। 


বিজ্ঞাপন


এলাকা ঘুরে জানা যায়, প্লাস্টিকের তৈরি প্লেট, গ্লাস, বাটি, ঘটি সব বাজারে আসায় মৃৎশিল্প এখন ধ্বংসের মুখে। এখন মাটির তৈজসপত্র তৈরি করে বেশি লাভের মুখ দেখেন না মৃৎশিল্পীরা। 

তারা বলেন, ‘আগে মাটি কিনতে হতো না, এখন মাটি কিনতে হয়। মাটির দাম বেশি, খড়ির দাম বেশি, লেবারের দাম বেশি হওয়ায় এখন এ কাজে লাভ বেশি হয় না তেমন।

কথা হয় জিতেন্দ্রনাথ পাল নামের এ প্রবীণ মৃৎশিল্পীর সঙ্গে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আমার বাপ-দাদারা এই কাজ করতো, এখন আমি ও আমার ছেলেরা এ ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি। সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও আমাদের শ্রমের মূল্য বাড়েনি। তাই কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করে চলছি।
Matir patro
 এলাকার ষাটোর্ধ্ব নারী শ্রী কমলা বালা, বয়সের ভারে নুয়ে গেছেন। ঠিকমতো বসতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘এক সময় অনেক কিছু তৈরি করতাম, এখন শুধু দই এর সরা তৈরি করি। আর কোনো কাজ করতে পারি না। তাই এই পেশা ছাড়তে পারি না। আগে দাম কম পেলেও লাভ হতো ভালো, এখন সবকিছুর দাম বাড়ায় তেমন লাভ হয় না। কোনোরকম পেটে দানা যায়।’ 

সংসারের কাজের পাশাপাশি এই এলাকার অনেক নারীকেই দেখা যায় দই এর হাঁড়ি তৈরি করতে। বিসু নামের এক মৃৎশিল্পী বলেন, ‘মাটির হাঁড়ি পাতিল এখন আর চলে না। ছোটকাল থেকে বাপ দাদার সঙ্গে কাজ করছি। তখন মাটির জিনিস খুব ব্যবহার হতো। দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের জিনিস বের হওয়ায় এখন মাটির জিনিস চলে না। এই শিল্পের সঙ্গে যারা আমরা রয়েছি তাদের চলা খুবই কষ্ট।

মৃৎশিল্পীদের ভাষ্য, মাটির তৈরি অন্যান্য পণ্যের কদর এখন তেমন না থাকলেও দইয়ের সরা ও হাঁড়ি-পাতিলের দিন দিন বেড়েই চলেছে। দইয়ের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় বগুড়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বলা যায়, এই দইয়ের পাত্রের চাহিদার উপর নির্ভর করেই জেলার মৃৎশিল্প টিকে আছে। তারা বলেন, দই-এর পাত্র তৈরি করেই টিকে আছে আমাদের পাল পাড়ার দুই হাজার পরিবার।  

জানা যায়, প্রতিদিন শত শত মণ দই তৈরি হয় এ জেলায়। দই সাধারণত মাটির তৈরি পাত্রেই রাখা হয়। বগুড়া জেলার চাহিদা মিটিয়ে এই দই এবং এর পাত্রও বিভিন্ন জেলায় যায়। আর সে কারণেই জিবীকা নির্বাহের জন্য এখনও এই পেশাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন জেলার অনেক মৃৎশিল্পী।
Matir patroমৃৎশিল্পীরা বলেন, একটি দইয়ের পাতিল বানাতে ৩০ টাকা, সড়া বানাতে ৪ টাকা ও কাপ বানাতে ৩ টাকার মতো খরচ হয়। স্থানীয় বাজারে এসব দইয়ের পাতিল ৫০ টাকা, সড়া ৭-৮ টাকা ও কাপ ৯ টাকায় বিক্রি করা হয়। 

বগুড়া সদরের নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর ও গাবতলী উপজেলায় গিয়েও দেখা মেলে এই পাল পাড়া। এইসব গ্রামে ঘুরে জানা গেল, মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জীবন ধারণের কথা। তারা জানালেন, মাটির কলস, হাঁড়ি, দইয়ের সড়া, বাসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, পিঠা তৈরির নানা ছাঁচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আগে বাসাবাড়িতে গ্রহণযোগ্য ছিল। বর্তমানে এসব তৈজসপত্রের ব্যবহার গ্রামে চললেও শহরে ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়। তাই তাদের আয়-রোজগারও এখন কমে গেছে। তবে, দইয়ের সড়া ও হাঁড়ির ব্যবহার এখনও আছে। ফলে এ শিল্পটিকে আঁকড়ে টিকে থাকার আশার আলো এখনো দেখেন তারা।

এই মৃৎশিল্পকে ধরে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া বিসিক উপ-মহাব্যবস্থাপক এ কে এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আধুনিকতার ছোয়ায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এই শিল্পটি। এই শিল্প হারিয়ে গেলে মৃৎশিল্পীরা বিপদগ্রস্ত হবেন। তাই  মৃৎশিল্প টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি স্বল্পসুদে ঋণ প্রদানসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর