সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ঢাকা

ব্রেস্ট ফিডিংয়ে অনীহা: প্রাণ সংহারের ঝুঁকিতে মা ও সন্তান

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ব্রেস্ট ফিডিংয়ে অনীহা: প্রাণ সংহারের ঝুঁকিতে মা ও সন্তান

পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মানবশিশুর প্রাথমিক ও প্রধান খাদ্য মায়ের বুকের দুধ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, মায়ের বুকের দুধ শুধুমাত্র শিশুদের খাদ্য বা পুষ্টির উৎস নয়, এটি শিশুর রোগ প্রতিরোধেরও প্রাথমিক উৎস। তবে শুধু শিশুর জন্যই নয়, মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এটি। শিশুর পাশাপাশি মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রেস্ট ফিডিং বা বুকের দুধ পান করানো। তবে দুঃখজনকভাবে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্রেস্ট ফিডিংয়ের হার ক্রমহ্রাসমান। বাংলাদেশে সংখ্যাটি আরও আতঙ্কের। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ও হেলথ সার্ভে ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের হার মাত্র ৫৫ শতাংশ। এক দশকে ব্রেস্ট ফিডিং বা বুকের দুধ খাওয়ানো কমেছে ১০ শতাংশ।

বর্তমান বিশ্বে প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম নিউমোনিয়া ও ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার।


বিজ্ঞাপন


নিউমোনিয়ায় বিশ্বে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে, যা এ বয়সী মোট শিশু মৃত্যুর শতকরা ১৪ শতাংশ। বাংলাদেশে নিউমোনিয়া পরিস্থিতি আরও খারাপ। নিউমোনিয়া নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের তথ্য মতে, দেশে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ২ থেকে ৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়। বছরে সংখ্যাটি প্রায় ২৪ হাজার। এটি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী। যা বিশ্বব্যাপী গড় থেকে বেশি।

 

আরও পড়ুন

অপরদিকে দেশে প্রতি বছর ১৩ হাজারেরও বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন। নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশই ভোগেন স্তন ক্যান্সারে।


বিজ্ঞাপন


 

নিউমোনিয়া ও স্তন ক্যান্সার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় মনে হলেও একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে রোগ দুইটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। দুই ক্ষেত্রেই অন্যতম প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর ব্রেস্ট ফিডিং না করানো।

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, ব্রেস্ট ফিডিং পাওয়া শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা না পাওয়া শিশুদের তুলনায় ১৫ গুণ কম। আর ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা স্তন ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্রেস্ট ফ্রিডিং না করানোকে।

নিউমোনিয়ায় মৃত্যু প্রতিরোধে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের বিকল্প নেই

ব্রেস্ট ফিডিং ও নিউমোনিয়ার সম্পর্ক তুলে ধরে আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সবসময় এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ওপর জোর দেই। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং বলতে বোঝায়, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুরা শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ পান করবে। এছাড়া অন্য কিছু খাবে না। তবে বাংলাদেশে এই সংখ্যাটি মাত্র ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ বাচ্চার মধ্যে মাত্র ৫৫ জন প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রেস্ট ফিডিং পাওয়া শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা না পাওয়া শিশুদের তুলনায় ১৫ গুণ কম। কারো যদি হয়েও যায় তবে তার মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক কম। কেননা তার তীব্র নিউমোনিয়া ও অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর মূল কারণ অক্সিজেনের স্বল্পতা। অর্থাৎ ব্রেস্ট ফিডিংয়ে শুধুমাত্র নিউমোনিয়া থেকে নয়, বরং এর তীব্রতা ও মৃত্যু থেকেও রক্ষা করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সারা বিশ্বেই অবহেলিত। বাংলাদেশে তা আরও বেশি অবহেলিত।
 
গবেষণার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি শুধুমাত্র আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য, বিষয়টি এমন নয়। এটি সারাবিশ্ব পরিচালিত গবেষণার ফলাফল। দেশে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের যে ডাটা দেওয়া হয়েছে তা বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ও হেলথ সার্ভে ২০২২ থেকে নেওয়া। তবে ব্রেস্ট ফিডিং পাওয়া শিশুদের নিউমোনিয়া হলেও তা তীব্র হয় না, এটি আমাদের নিজস্ব গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য। ২০১০-১১ সালে পরিচালিত গবেষণায় আমরা পেয়েছি যে, এসব শিশুর রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা খুব কম হয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, বুকের দুধ পানে নিউমোনিয়াসহ একাধিক রোগের এন্টিবডি বাচ্চার শরীরে জন্মায়। আমরা যাকে শাল দুধ বলি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সিজারিয়ান সেকশনে মাঝে মাঝে এতে সমস্যা হয়। কিছু কিছু মা নানা কারণে বাচ্চা থেকে দূরে থাকেন। এ সময় পর্যপ্ত খাবার পাচ্ছে না বলে তাদের ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হয়। এতে অনেক শিশুদের ডায়রিয়া দেখা দেয়। যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এসব শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। একইসঙ্গে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

 

আরও পড়ুন

 

সচেতনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা দূর করতে সচেতনার বিকল্প নেই। প্রথমত আমাদের নরমাল ডেলিভারি বাড়াতে হবে। প্রসবকালীন পরিচর্যার ব্যাপারে মায়েদের প্রস্তুত করতে হবে। কি করলে বাচ্চারা দুধ বেশি পাবে তা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ইদানিং আমাদের কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। তারা যেখানে কাজ করে সেখানে শিশু রাখার মতো জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেখানে যেন ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা গেলে আমরা এই অবস্থার কিছুটা উত্তরণ করতে পারব।

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে ব্রেস্ট ফিডিং

বাংলাদেশে স্তন ও জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে দীর্ঘদিন কাজ করছেন জনস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বলে আসছি স্তন ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর ব্রেস্ট ফিডিং না করানো। পূর্বে আমাদের দেশে শতভাগ না হলেও ৯০-৯৯ শতাংশ ব্রেস্ট ফিডিং হতো। স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যার কারণে হয়তো অল্প কিছু সংখ্যাক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। এখন তা অনেক কমেছে। এর নানাবিধ কারণ রয়েছে, এর একটি হতে পারে আমাদের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে। দেরিতে বিয়ে হওয়া ও বাচ্চা গ্রহণও তার মধ্যে অন্যতম। এর মাঝে কর্মজীবী নারীরা ব্রেস্ট ফিডিং করানোর মতো সময় ও পরিবেশ পাচ্ছে না। আমাদের এখানে ডে কেয়ার ও ব্রেস্ট ফিডিংয়ের সুযোগ খুবই অল্প। স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে এটি করতে পারেন না। বাচ্চা খায় না, দুধ পাচ্ছে না— এ ধরনের অভিযোগও শোনা যায়। যদিও সবগুলোরই সমাধান রয়েছে।

সচেতনতা তৈরিতে জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের লেখা ও বক্তব্যে সবসময় ব্রেস্ট ফিডিংয়ের বিষয়টি উল্লেখ করি। বিশেষ করে ছয় মাসের মধ্যে ব্রেস্ট ফিডিং ছাড়া অন্যকিছু খাওয়ানো যাবে না— এটা আমরা বলে থাকি। আমরা প্রতিনিয়ত মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করছি। আমরা মানুষকে বোঝাচ্ছি, এটির মাধ্যমে মা ও শিশু উভয়ই নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি পেতে পারেন। স্তন ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম।

এমএইচ/

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর