মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ প্রত্যেক নারীর জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া। কবির ভাষায় ‘মাতৃত্বের অনুভূতি হলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। আর মাতৃত্বের সুখ হলো, পার্থিব সমস্ত সুখের শ্রেষ্ঠ’। তবে নানা কারণে এই সুখের অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হন নারীরা। নিজের অজান্তেই প্রজননের সক্ষমতা হারান তারা। এসব কারণের মধ্যে অন্যতম পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম সংক্ষেপে পিসিওএস। প্রজননক্ষম মহিলাদের একটি অন্যতম প্রধান হরমোন ও বিপাকজনিত সমস্যা। নারীদের নানা জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম পিসিওএস। হরমোনজনিত এই রোগটির কারণে অনিয়মিত মাসিক হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, দেহে লোমের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি তা বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে শঙ্কার বিষয় হলো রোগটির বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা নেই। ফলে অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবে অনেক নারী নিজের অজান্তেই তার প্রজনন ক্ষমতা চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলছেন। অথচ সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে অনেকাংশেই এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞাপন
চিকিৎসকদের তথ্যমতে, প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন এ সমস্যায় আক্রান্ত। মাসিক শুরু হওয়ার পর কিশোর বয়স থেকেই এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। কিন্তু সামাজিক কারণে মেয়েরা তা প্রকাশ করতে পারে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭০ ভাগ মহিলার এ রোগটি নির্ণয়ই হয় না। ফলে নারীরা গর্ভধারণে জটিলতা, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এছাড়াও মেটাবোলিক সিনড্রোম যেমন হৃদনালি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হওয়া, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ বাড়া, বিষণ্নতা অনুভব করা, জরায়ু থেকে রক্তপাত হওয়া, তলপেটে তীব্র ব্যথা হওয়া ও যকৃতে প্রদাহের মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারেনে।
কিশোর বয়সে মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকেই পিসিওএসের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। হরমোনজনিত এ রোগে আক্রান্ত নারীদের ওজন বৃদ্ধি পায়, শরীরে অপ্রয়োজনীয় চুল গজায়, প্রতিনিয়ত চুল পড়া বা চুলের ঘনত্ব হালকা হতে থাকা, ত্বক অতিরিক্ত তেলতেলে হয় বা ব্রণ হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বক কালো হয়ে যেতে থাকে। এসব অঙ্গের মধ্যে রয়েছে হাত কিংবা স্তনের নিচের ত্বকে, গলার পেছনের অংশ, কুঁচকিতে কালো দাগ ইত্যাদি। এছাড়া ঘুমে সমস্যা হওয়া, সারাক্ষণ দুর্বলতা অনুভব করা, মাথাব্যথা, অনিয়মিত পিরিয়ড (মাসিক) হওয়া।
পিসিওএসের লক্ষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর বয়সে মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকেই পিসিওএসের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। হরমোনজনিত এ রোগে আক্রান্ত নারীদের ওজন বৃদ্ধি পায়, শরীরে অপ্রয়োজনীয় চুল গজায়, প্রতিনিয়ত চুল পড়া বা চুলের ঘনত্ব হালকা হতে থাকা, ত্বক অতিরিক্ত তেলতেলে হয় বা ব্রণ হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বক কালো হয়ে যেতে থাকে। এসব অঙ্গের মধ্যে রয়েছে হাত কিংবা স্তনের নিচের ত্বকে, গলার পেছনের অংশ, কুঁচকিতে কালো দাগ ইত্যাদি। এছাড়া ঘুমে সমস্যা হওয়া, সারাক্ষণ দুর্বলতা অনুভব করা, মাথাব্যথা, অনিয়মিত পিরিয়ড (মাসিক) হওয়া। এ রোগে মাসিককালীন সময়ে অতিরিক্ত রক্ত যাওয়ার ফলে গর্ভধারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
>> আরও পড়ুন: প্রতি ১০ নারীর একজন পিসিওএসে ভুগছেন
সাম্প্রতিক সময়ে পিসিওএস বিষয়ক এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে এ রোগের নানাদিক তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. ফরিদউদ্দিন। তিনি এ রোগের লক্ষণ তুলে ধরে সচেতন ও আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন বলেন, হরমোনজনিত রোগ নিরাময়ের ক্লিনিক্যাল পার্টের সাথে সোশ্যাল পার্টটা সবার ভালো করে জানতে হবে। বন্ধ্যাত্ব, অবাঞ্ছিত লোম-এ ধরনের রোগীর সাথে সুন্দর আচারণ করে, বুঝিয়ে তাকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এ ধরনের রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধে প্রয়োজন সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা। চিকিৎসকদের পাশাপাশি গণমাধ্যমও এই ধরনের রোগের চিকিৎসায় সর্বত্র সচেতনতা তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
বন্ধ্যাত্ব ও পিসিওএস
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের সাথে নারীদের বন্ধ্যাত্ব সমস্যার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক ও করণীয় নিয়ে ঢাকা মেইলের সাথে কথা হয় বিএসএমএমইউর রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ডোক্রিনোলজি অ্যান্ড ইনফারটিলিটি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানুর। তিনি বলেন, বন্ধ্যাত্বের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসা রোগীদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পিসিওএসে আক্রান্ত থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, মহিলাদের প্রতি দশজনে একজনের পিসিওএস দেখা যায়। তবে সবার বন্ধ্যাত্ব হয় তেমন নয়। তাদের অন্তত ৭০ শতাংশের বন্ধ্যাত্ব সমস্যা দেখা দেয়। শতকরা ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিসের ‘কি’ লক্ষণগুলোতে ভোগেন। এর মধ্যে রয়েছে, গ্লোকোজ ইনটলারেন্স, ইনসুলিন রেজিস্ট্রেন্স মতো জটিল সমস্যা। অনিয়মিত মাসিক থাকে ৫০ শতাংশ রোগীর। এছাড়া শরীরে লোমের আধিক্য, অতিরিক্ত ওজন, বাচ্চা গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস, এক্লাম্পসিয়া (গর্ভকালীন সময়ে খিঁচুনি) মতো জটিলতা দেখা দেয়।
>>আরও পড়ুন:
ভারতে নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ: কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?
সঠিক সময়ে আসেন না চিকিৎসক, রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষা
মায়েদের সচেতন হওয়ার তাগিদ নিয়ে প্রখ্যাত এই প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, পিসিওএসজনিত বন্ধ্যাত্ব ও অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বিশেষত মায়েদের। ১৪-১৫ বছর থেকে মাসিক শুরু হওয়ার পর কিশোরীদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে হবে। মাসিক নিয়মিত হচ্ছে কিনা, ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি লক্ষ্য রাখতে হবে। কারো যদি দেড় থেকে দুইমাস পরপর মাসিক হয় বা বছরে ৮ বারের কম মাসিক হয়, ওজন বাড়তে থাকে, শরীরে লোমের আধিক্য দেখা দেয় তাহলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসা নিয়ে মাসিক নিয়মিত করতে হবে, ওজন কমাতে হবে এবং ব্যায়াম করতে হবে।
কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়
অধ্যাপক ডা. জেসমিন বানু জানান, এই রোগ হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে জিনগত, প্রদাহ, পরিবেশগত বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এমন কি স্ট্রেস (মানসিক চাপ) থেকেও এ সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমান সময়ে ফাস্টফুড জাতীয় খাবার দাবার গ্রহণও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিসিওএস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ নয়, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কারণ এটি একটি সিমটমিক রোগ। চিকিৎসার মাধ্যমে এর সিমটমগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন অনিয়মিত মাসিকের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ শতাংশ ওজন কমানো সম্ভব হলে, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে মাসিক নিয়মিত হয়ে যায়। তাহলে ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে মেটাবলিক সিনড্রোমসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যা শুরুতেই সচেতন হলে প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে এতে জটিলতা হবে না।
এমএইচ/এএস