ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মদিনায় হিজরত। এই যাত্রার সূচনালগ্নে সংঘটিত সাওর গুহায় রাসুল (স.) ও তাঁর বিশ্বস্ত সাহাবি হজরত আবু বকর (রা.)-এর তিন রাতের অবস্থান একটি কালজয়ী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এটি শুধু আত্মগোপনের ঘটনা নয়, বরং ঈমান, কৌশল, ধৈর্য এবং আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনার এক অপূর্ব সম্মিলন।
হিজরতের প্রেক্ষাপট: ষড়যন্ত্রের অন্ধকারে আলোর পথে যাত্রা
নবুয়তের ১৩তম বছরে মক্কার কুরাইশ নেতারা দারুন নাদওয়ায় একত্র হয়ে রাসুল (স.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি হিজরতের প্রস্তুতি নেন। হিজরতের রাতে, রাসুল (স.) হজরত আলী (রা.)-কে নিজের বিছানায় রেখে গোপনে বাড়ি ত্যাগ করেন। এরপর তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী হজরত আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে মদিনার উল্টো দিকে দক্ষিণে অবস্থিত সাওর পাহাড়ের একটি গুহায় আশ্রয় নেন, যেখানে তাঁরা তিন রাত আত্মগোপন করেন।
আরও পড়ুন: হিজরতের মাসে যে আমলের প্রতি বেশি মনোযোগী হবেন
সাওর গুহার তিন রাত: ভয়, আশ্বাস ও নির্ভরতার গল্প
গুহায় অবস্থানকালে কুরাইশ অনুসন্ধানকারীরা গুহার কাছাকাছি চলে আসে। তাদের পায়ের আওয়াজ শুনে আবু বকর (রা.) আশঙ্কায় বলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি তারা নিচের দিকে তাকায়...’ রাসুল (স.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- ‘লা তাহযান, ইন্নাল্লাহা মাআনা’ ‘চিন্তা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা তাওবা: ৪০; সহিহ বুখারি: ৩৬৫৩)
বিজ্ঞাপন
এই আয়াত শুধু এক আশ্বাস নয়, বরং চিরন্তন বিশ্বাসের এক ঘোষণাপত্র।
আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থা: সাধারণ মাধ্যমে অসাধারণ কুদরত
সিরাত ইবনে হিশাম ও তাফসির ইবনে কাসির অনুযায়ী, আল্লাহর কুদরতে গুহার মুখে একটি মাকড়সা জাল বুনে দেয় এবং একটি কবুতর সেখানে ডিম পেড়ে বসে থাকে। এই দৃশ্য দেখে কুরাইশ অনুসন্ধানকারীরা গুহায় প্রবেশ না করে ফিরে যায়, কারণ তারা ভেবেছিল এখানে কেউ প্রবেশ করেনি। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহ যখন কাউকে রক্ষা করতে চান, তখন অতি সাধারণ জিনিসও তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনার অংশ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: হিজরতের সময় যেভাবে আবু জেহেলরা সবাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল
সাহাবিদের নীরব ভূমিকা
এই তিন রাতের সফল আত্মগোপনের পেছনে ছিলেন কিছু সাহাবি, যাঁদের ভূমিকা ছিল নিঃশব্দ কিন্তু অপরিহার্য। যেমন- আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) মক্কার খবর ও কুরাইশদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে রাতে গুহায় এসে তা জানাতেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে খাবার ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতেন। আমির ইবনে ফুহায়রা (রা.) ছাগল চরিয়ে গুহার কাছাকাছি আসতেন, যাতে তাদের পায়ের ছাপগুলো মুছে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিত একজন অমুসলিম হলেও তার বিশ্বস্ততার কারণে তাকেই পথপ্রদর্শক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই দলগত প্রচেষ্টা প্রমাণ করে সুনির্বাচিত দল, কৌশল ও প্রস্তুতিও সফলতার পূর্বশর্ত।
মদিনার পথে যাত্রা: ইতিহাসের মোড়বদলের মুহূর্ত
তিন রাত পর রাসুল (স.) ও আবু বকর (রা.) গুহা ত্যাগ করে আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিতের সহায়তায় মদিনার পথে যাত্রা করেন। এই যাত্রা পরবর্তীতে ইসলামি হিজরি সনের ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়, যা আজো মুসলিম বিশ্বে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের জন্য শিক্ষা
এই ঘটনা শুধু ঐতিহাসিক স্মৃতিই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য জীবন্ত শিক্ষা।
- আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল: সব দরজা বন্ধ হলেও তিনি ব্যবস্থা করেন।
- হিকমাহ (বুদ্ধিমত্তা): কৌশল ও দূরদর্শিতা ঈমানের অংশ।
- সঠিক সঙ্গীর গুরুত্ব: সংকটে পাশে থাকার মতো বিশ্বস্ত মানুষ খোঁজা জরুরি।
- দলগত সহযোগিতা: একার নয়, সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বিজয় আসে।
- নীরব প্রচেষ্টা: যারা আলোচনায় আসেন না, তারাও ইতিহাস গড়েন।
সারসংক্ষেপ: সময়কে অতিক্রম করে প্রেরণা
সাওর গুহার এই তিন রাত অন্ধকারে আলোর প্রতীক। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর সাহায্য তখনই আসে, যখন বিশ্বাস ও কর্ম একসঙ্গে চলে। আজ যখন আমরা জীবনসংকটে পড়ি, তখন রাসুল (স.)-এর সেই বাণীই ভরসা দেয়- ‘চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

