সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

হিজরতের সময় যেভাবে আবু জেহেলরা সবাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৫:৫০ পিএম

শেয়ার করুন:

হিজরতের সময় যেভাবে আবু জেহেলরা সবাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল

নবীজি (স.) সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের আদেশ করলেন। তাঁরা দলে দলে মদিনার পথ ধরলেন। আনসাররা মদিনায় তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন, নিজ ঘরে মেহমান বানালেন। তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন সহযোগিতার হাত। এভাবেই ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো মদিনায়। (জাদুল মাআদ: ১/৯৭)

মুশরিকদের হাতে আটকে পড়া কিছু অক্ষম মুসলমান ছাড়া পুরো মক্কায় তেমন কোনো সাহাবি অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তখনও মক্কায় রয়ে গেলেন আল্লাহর নবী (স.)। সঙ্গে রাখলেন আবু বকর ও আলী (রা.)-কে। সহিহ বুখারির বিশুদ্ধ বর্ণনামতে, ‘হজরত আবু বকর (রা.) অন্য সাহাবিদের মতো হিজরতের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু নবীজি তাঁকে বললেন, অপেক্ষা করো, আশা করছি আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেওয়া হবে।... অতঃপর আবু বকর (রা.) ও নবীজির সঙ্গী হতে রয়ে গেলেন মক্কায়। আর সফরের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রায় চার মাস দুটি উষ্ট্রী বাহনের পরিচর্যা করতে লাগলেন। (সহিহ বুখারি: ৩৯০৫)


বিজ্ঞাপন


হিজরতের সময় মদিনার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবু বকর (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিত নামে এক ব্যক্তিকে ভাড়া করেন। সে আরবের পথঘাট সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮৪ ও ৩৮৭; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১৭৪)

মুশরিকদের ঔদ্ধত্য চরম আকার ধারণ করল। তারা নবীজির ব্যাপারে রাতে দারুন নদওয়ায় পরামর্শসভায় বসল। কেউ বলল, নবীজিকে বন্দী করতে আর কেউ বলল, তাঁকে চিরতরে দেশান্তর করতে। পরে সম্মত হয়ে তারা পরিকল্পনা আঁটল, আগামীকাল সকালেই প্রিয়নবী (স.)-কে হত্যা করার। কোরাইশ নেতৃস্থানীয়রা সর্বসম্মতিক্রমে দারুন নদওয়ায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নবীজিকে হত্যার জন্য তাঁর বাসস্থান ঘেরাও করল। বাছাই করা ১১ জন ব্যক্তি নবীজির বাসভবনের চারিদিকে ওঁত পেতে রইল। তারা অপেক্ষা করতে লাগল যে, তিনি শুয়ে পড়লে একযোগে হামলা করবে। এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সফল হবে বলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস ছিল তাদের। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮২)

আবু জেহেল তার সঙ্গীদের সঙ্গে ঠাট্টা মশকারা করছিল আর বলছিল- মুহাম্মদ বলে, তোমরা যদি তার অনুসরণ করো তবে আরব-অনারবের বাদশাহ হবে। এরপর মৃত্যু হলে পুনরুজ্জীবিত হবে আর জর্দানের বাগানের মতো জান্নাত থাকবে। যদি তোমরা তাকে না মারো, তবে তারা তোমাদের জবাই করবে এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হলে তোমাদের আগুনে পোড়ানো হবে। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮৩)

ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল রাত ১২টার পর। এ কারণে নির্ঘুম চোখে নির্ধারিত সময়ের প্রতীক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে- আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। তিনি নিজের ইচ্ছাই সফল করে থাকেন। তিনি যাকে বাঁচাতে চান, কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। যাকে পাকড়াও করতে চান, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। প্রিয়নবী (স.)-কে সম্বোধন করে তিনি ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী!) আপনি ওই সময়টি স্মরণ করুন, যখন কাফেররা চক্রান্ত আঁটছিল যে, তারা আপনাকে বন্দী করবে, অথবা হত্যা করবে কিংবা করবে দেশান্তর। তারা তাদের ষড়যন্ত্র করছিল আর আল্লাহ আপন কৌশল করছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী। (সুরা আনফাল: ৩০)


বিজ্ঞাপন


কোরাইশ কাফেররা সর্বাত্মক চেষ্টা করেও বিফল হলো। সকল পরিকল্পনা নস্যাৎ হলো। প্রিয়নবী (স.) হজরত আলি (রা.)-কে বললেন, তুমি আমার এই সবুজ হাদরামি চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাকো। ওদের হাতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। প্রিয়নবী (স.) এই চাদর গায়ে জড়িয়ে রাতে ঘুমাতেন। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮২, ৪৮৩)

আল্লাহ তাআলা নবীজিকে নির্দেশ দিলেন, রাতে নিজ ঘরে শয়ন না করে তাঁর স্থানে হজরত আলী (রা.)-কে রাখতে। এভাবে নবীজির অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, জিব্রাইল (আ.) হিজরতের নির্দেশ সম্বলিত আসমানি বার্তা নিয়ে এলেন। আয়াত নাজিল হলো- ‘আর (হে নবী) আপনি বলুন, হে আমার রব! আমাকে প্রবেশ করান কল্যাণের সঙ্গে এবং আমাকে বের করুন কল্যাণের সঙ্গে। আর আমাকে আপনার পক্ষ হতে দান করুন সাহায্যকারী শক্তি।’ (সুরা বনী ইসরাইল: ৮০)

এরপর রাসুলুল্লাহ (স.) এক মুঠো ধুলো নিয়ে বাইরে এলেন এবং কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। এতেই আল্লাহ তাআলা তাদের অন্ধ করে দিলেন। ফলে তারা আল্লাহর রাসুলকে দেখতে পেল না। সেসময় নবীজি (স.) এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন যে ‘আমি ওদের সামনে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপন করছি এবং ওদেরকে আবৃত করছি। ফলে ওরা দেখতে পায় না।’ (সুরা ইয়াসিন: ৯)

প্রত্যেকের মাথায় নিক্ষিপ্ত ধুলোবালি গিয়ে পড়ল। এরপর তাদের ওই অন্ধ অবস্থায় তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁত পেতে থাকাদের কেউ কিছুই দেখতে পেল না। নবীজি তখন হজরত আবু বকরের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেই ঘরের একটি জানালা পথে বেরিয়ে উভয়ে মদিনার উদ্দেশে ইয়েমেনের পথে যাত্রা করলেন। কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত সওর পাহাড়ের একটি গুহায় তাঁরা যাত্রাবিরতি করলেন। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃ-৪৮৩; জাদুল মাআদ: দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-৫২)

২৭ সফর মোতাবেক সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (স.) হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর দুই স্ত্রী আয়েশা ও সাওদা (রা.)-কে এবং দুই ছোট কন্যা উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (রা.)-কে মক্কায় ছেড়ে যান। অন্য কন্যা জয়নব (রা.) মুশরিক স্বামীর সঙ্গে তখনো মক্কায় অবস্থান করছিলেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮৪ ও ৩৮৭; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৭৪)

হিজরতের এই ঐশী হুকুম ও মহান ইবাদত পালনের মধ্য দিয়ে পদে পদে নেমে আসে আল্লাহর গায়েবি মদদ। হিজরত ইসলাম, মুসলমান ও প্রিয়নবী (স.)-এর জীবনের 'টার্নিং পয়েন্ট'। হিজরতের পর মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিগ-দিগন্তে। 

(সূত্র: আর রাহিকুল মাখতুম)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর