শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিমান কি বদলে যাচ্ছে?

মাহমুদ হাসান
প্রকাশিত: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

বিমান কি বদলে যাচ্ছে?

মুক্তচিন্তায় বাধা আসলে, সত্যের পরিস্ফুটন ঘটে না। সত্য বিবর্জিত লেখা পাঠক মনে যেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তেমনি লেখকও তার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারকে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রয়াত মওদুদ আহমেদ ছিলেন এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত ছিল না। কেউ তাকে সুবিধাবাদী আবার কেউবা তাকে চতুর বলতেন। তবে মেধা, পাণ্ডিত্য আর বিচক্ষণতায় তিনি অনেককেই ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমেদকে নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, লেখক মওদুদ আহমেদ নানা কারণেই অনেকের পছন্দের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিএনপির রাজনীতি করে, দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন হয়েও লেখক মওদুদ দলীয় মতাদর্শ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেছিলেন, চিন্তাশক্তি বন্দি হলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তার সৃষ্টি একদিন হারিয়ে যেতে পারে, তাই লেখক মওদুদ সত্যাশ্রয়ী হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। আজকের সামাজিক বাস্তবতায় সত্যাশ্রয়ী হওয়া যেন দিন দিন বড় কঠিন হয়ে উঠছে। 'ভয়' যেন চারপাশে তাড়া করে ফিরে।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: ধনী-গরিবে এত বৈষম্য কেন?

ভয়, চারিদিকে ভয়। এ যেন ভয়ের অক্টোপাস। মত প্রকাশের ভয়, মুক্ত মনে লিখতে গিয়ে ভয়, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভয়, চৌদ্দ পুরুষের ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে সন্তানের বেড়ে উঠার ভয়। এ যেন ভয়েরই সংস্কৃতি। যারা লিখে, সৃজনশীলতার চর্চা করে, তাদের ‘বুদ্ধিজীবি’র তকমা লাগার ভয়। হাড়ভাঙা খাটুনিতে পরবাসে যা আয় রোজগার হয়, স্বজনরা ভোগ বিলাসে সেই কষ্টার্জিত অর্থ উজাড় করে দেয়ার ভয়। শুভাকাঙ্ক্ষী বেশে জাল-জালিয়াতি করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার ভয়। ভালোবাসার আদর্শ বাঁচিয়ে রাখতে বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা করলে নব্য রাজাকার হয়ে যাওয়ার ভয়।

‘নীলাম্বর টিভি’ ক্যালগেরির বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রথম বাংলা টিভি চ্যানেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসকে বিকশিত করতে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ চ্যানেলের একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে ৭১’। বাংলাদেশ ও প্রবাসে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। গেল সপ্তাহে এক মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথার গল্প শুনছিলাম। যিনি মুক্তিযুদ্ধে বাবা, চাচাসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে হারিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে শুধু আপনজন নয়, ভিটে-মাটি আর জমি-জমাতেও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। একজন যুদ্ধজয়ী কমান্ডার হয়েও স্বাধীনতার একান্নতম দিবসেও খুনি, রাজাকার, আল-বদরদের নাম বলতে ভয় পান। দর্শক আর সঞ্চালকের বারংবার অনুরোধে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ভয়, চারিদিকে ভয়। সেই দুঃসাহস আজ আর নেই। এমন সামাজিক বাস্তবতায় আমার মতো চুনোপুঁটি লেখকরা তো ডাল-ভাত।

>> আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ নারী


বিজ্ঞাপন


বিমান নিয়ে লিখতে গেলে মাঝেমাঝে কলম থেমে যায়। ‘ভয়’ আমাকে তাড়া করে ফিরে। সাফল্যের কথা লিখতে গিয়েও ভয়, ব্যর্থতায় আরও ভয়। বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় আমার পরিচিতজন। চারপাশের অনেকেই, তার সাথে সম্পর্কের বিষয়টি অবহিত। সফলতার কথা লিখলে, কেউ বলবেন মন্ত্রীকে খুশি করতে চাই। আবার ব্যর্থতার কথা লিখলে বলবেন, তাকে বিতর্কিত করতে চাই। তাই পারতপক্ষে বিমান, এভিয়েশন আর পর্যটনকে চিন্তাশক্তির বাহিরে রাখতে স্বস্তি বোধ করি। তবুও মাঝেমাঝে আবেগকে প্রশমিত করা বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠে।

২৬ মার্চ ২০২২, বলাকা খচিত লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স টরন্টোর পিয়ারসন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে, এ সংবাদে নিজের আবেগকে সংবরণ করা বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল। তাই ‘বিমানের সাফল্য চাই’ শিরোনামে লিখেছিলাম। যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকার মতামত কলামে ২৫ মার্চ ২০২২ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন নানা প্রত্যাশার কথা লিখেছিলাম, সফলতার অন্তরায় কি হতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কানাডার প্রবাসী কমিউনিটিতে বাংলাদেশ বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইট নিয়ে চরম এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজমান ছিল। কেউ বলছিলেন লোক দেখানো, কেউবা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন।

>> আরও পড়ুন: নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব

ভেবেছিলাম, বছর পূর্তিতে বিমান নিয়ে লিখব। সেই লক্ষ্যে ঢাকা-টরন্টোর বিমান যাত্রীদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। উদ্বোধনী ফ্লাইটের যাত্রী চাকসুর সাবেক জিএস আজিম ভাই থেকে শুরু করে শতাধিক যাত্রীর মতামত জানার সুযোগ হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বহু গল্প পড়ারও সৌভাগ্য হয়েছে। যারা একসময় বিমানের সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাদের আত্মতুষ্টির কথা শুনে বিস্ময় লাগে। কেউ বলছে, অসাধারণ গ্রাহক সেবা, কেউ বলছে তুলনাহীন, কেউবা বলছে এখন থেকে স্বদেশ ভ্রমণে বিমানই প্রথম এবং শেষ পছন্দ। একটু আগ বাড়িয়ে কেউবা বলছেন, ‘আমার দেখা সর্বোচ্চ গ্রাহক সেবা। খাবারের মান, আর বিমানকর্মীদের আচার-আচরণে সবার কণ্ঠেই স্বস্তির সুর। এসব শুনে বিস্ময় লাগে, প্রশ্ন জাগে, বিমান কি তাহলে বদলে যাচ্ছে।

পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কিছু যাত্রীর অভিযোগ আছে, তবে এ দায়টি কোনোভাবেই শুধুমাত্র বিমান ক্রুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে যাত্রীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টিকিটিং আরও সহজলভ্য হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় অনলাইনে টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠে, আবার অনেক যাত্রী অনলাইনের চেয়ে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট ক্রয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আক্ষেপ আছে, টরন্টোর বাইরে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না বা টিকিট করার সুযোগ নেই। ক্যালগেরি, ভ্যাঙ্কুবার, মন্ট্রিলের মতো শহরে প্রচুর বাংলাদেশি বসবাস করলেও এসব শহরের সাথে কোনো ডমেস্টিক এয়ারলাইন্সের কানেকটিং না থাকায় পছন্দের শীর্ষে থাকলেও অনেক যাত্রী বিমানের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখলে উদ্দেশ্য পূরণে অনেক বেশি সহায়ক হতে পারে।

>> আরও পড়ুন: ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং

যাত্রীসেবা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। তাবৎ দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধেও অসন্তুষ্টির অভিযোগ শোনা যায়। তবে এর মাত্রা কতটা সহনীয়, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত ছয় মাসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইট নিয়ে বিবেচনা নেয়ার মতো কোনো অভিযোগ চোখে পড়েনি। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে একটি ফ্লাইট সময়মতো ঢাকায় অবতরণ করতে না পারায়, দীর্ঘ পরিভ্রমণে ক্লান্ত শিশুসন্তানসহ এক যাত্রীর ফেসবুক লাইভ, কিছুটা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ হলেও এটি কোনোভাবেই যাত্রীসেবার সাথে সম্পর্কিত ছিল না।

বিমান নিয়ে নেতিবাচক গল্প শুনেই আমরা অভ্যস্ত। এর মাঝে বিমানের টরন্টো অফিস কি ব্যতিক্রম। গত মাসে বাংলাদেশ বিমানে দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চার সদস্যের এক পরিবার পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতায় নির্দিষ্ট তারিখে যাত্রা করতে পারেনি। আবার গ্রহণযোগ্য সময়ে টিকিট বাতিলও করতে পারেনি। সমস্যাটি নিয়ে গ্রাহক সশরীরে বিমান অফিসে হাজির হয়েছিলেন। তদবির ছাড়া দ্রুততম সময়ে এমন সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানে যাত্রীর মন্তব্য, বিমান কি তাহলে বদলে গেছে? তবে বিমানের টরন্টো অফিসের ফোন সংযোগ নিয়ে অনেক আক্ষেপের কথা শোনা যায়। জনবলের সঙ্কট হয়তো এ ক্ষেত্রে মুখ্য কারণ হতে পারে।

>> আরও পড়ুন: জলবায়ু উদ্বাস্তু মোকাবেলায় নজর দেওয়ার সময় এখনই!

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাতে প্রচারিত একটি সংবাদ মনে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্স’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে। সংবাদটি সুখকর, চ্যালেঞ্জ থাকলেও অসম্ভব নয়। বিমানের ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইট, পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলই তার অকাট্য প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু কন্যার আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রাখতেই নাকি এই স্বপ্ন বিলাসী পরিকল্পনার সূত্রপাত। সামাজিক ব্যাধি দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে পারলে, আর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ঢাকা-টরন্টো পথের যাত্রীসেবার অনুকরণে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আর বিমানের সকল রুটে যদি সমমানের সেবা অব্যাহত রাখা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্সে’ রূপান্তরের পরিকল্পনা কোনোভাবেই কল্পনাপ্রসূত নয়। লাল-সবুজের পতাকায় বলাকাখচিত বিমান ‘স্মার্ট এয়ারলাইন্স’ হয়ে জাতীয় গৌরবের অংশীদার হয়ে উঠুক- এটিই আজকের প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ সম্পাদক, আলবার্টা রাইটার্স ফোরাম, কানাডা।

জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর