শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ধনী-গরিবে এত বৈষম্য কেন?

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ধনী-গরিবে এত বৈষম্য কেন?

বছর আসে, বছর যায়। অর্থনীতির উন্নতি হয়। কিন্তু লাভ হয় কেবল বড়লোকদেরই। গরিব মানুষের জীবনে কোনো উন্নতি নেই। খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চারশ’ বছর আগে এথেন্সে বসে দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, শহরের আকার যত ছোটই হোক না কেন, তা মূলত দুভাগে বিভক্ত। ধনী আর গরিব। ধনী-গরিবের এই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছেই। এই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলবেই।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অপরাধমূলকভাবে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। পৃথিবীতে ধনীর ধনভাণ্ডার যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই পরিমাণ ধনভাণ্ডার যদি গরিব দূর করার কাজে ব্যবহার হতো তাহলে বিশ্বে আর ধনী-গরিব ভেদাভেদ থাকত না।


বিজ্ঞাপন


দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে বাংলাদেশ। শহরে যেমন সুউচ্চ ভবন বাড়ছে, বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। বাজার থেকে শুরু করে সব জায়গায় সিন্ডিকেটের রাজত্ব। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি আজও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে তুলছে। একদিকে বাড়ছে বসবাসের সিটি ও শপিংমল, অন্যদিকে বাড়ছে বস্তির সংখ্যা। মানুষের ভেতরে এই বৈষম্য দূর না হলে কোনো উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে না।

>> আরও পড়ুন: মেট্রোরেল ও প্রতীক্ষার অবসান

নতুন বছরের প্রথম প্রহরে বছরকে উদযাপন করতে বহু রঙের আতশবাজি, ফানুস আর রাতভর ডিজে পার্টির শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল ঢাকার শহরের বিভিন্ন এলাকা। কিন্তু নতুন বছরের সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করেনি নগরীর নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। ব্যস্ততার মাঝেও নিজেদের টানাপোড়নে চলছেন বস্তির বাসিন্দারা। নতুন বছরের আনন্দ তো দূরের কথা, বস্তিবাসীর প্রত্যেককে থাকতে হয় নানা আতঙ্কের মধ্যে। ছোট একটি জায়গায় গাদাগাদি করে অন্তত ২০০০ মানুষ বাস করছে। তবে বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস আসে অহরহ।

নগরীর বড় বড় আকাশ ছোঁয়া সুউচ্চ ভবনের পাশে বস্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে শত আনন্দের ভেতরেও হাত সম্বল মানুষগুলো একটু আনন্দ করার বা অবসরের সুযোগ পায় না। বস্তিবাসী এসব লোকের কাছে গেলে দেখা যাবে পুরুষ সদস্যরা কাজে বেরিয়ে পড়েছেন। বাড়ির নারী সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঘরের কাজ সারতে। এই নারীদের অনেকেই আবার আশপাশের এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। তারা যেখানে থাকেন সেখানে প্রতি মাসে একটি ঘর বাবদ ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো। নতুন বছরের আনন্দ তো দূরে থাক, তারা বরং আতঙ্কে আছেন কবে না আবার বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিস আসে। ছোট্ট একটি ঘরে একটা বিছানা ফেলে কোনোরকমে থাকতে হয় তাদের। এই ঘরের ভাড়া দিতেও কষ্ট হয়। এভাবেই চলে তাদের জীবন।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: থিওরিটিক্যালি ও প্র্যাকটিক্যালি বিএনপি ‘আদর্শহীন’

অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাদের। আগে ৫শ টাকায় হাতভরে বাজার হতো। এখন ৫শ টাকায় একমুঠো বাজার আনতে পারে না। কয়টা আলু, পেঁয়াজ, সবজি কিনলেই শেষ। প্রায় প্রতিদিনই তাদের খাবার রুটিন আলু, বেগুন না হলে শাকসবজিতে সীমাবদ্ধ। মুরগির মাংস জোটে মাসে দুই-একবার। অন্যদিকে গরুর মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাতেও আনতে পারেন না। গরুর মাংস খান বছরে একদিন, কোরবানির ঈদে। আর না হলে ভাগ্যে জোটে না গরুও মাংস। গ্যাস ও পানির সঙ্কটে থাকে এরা। ভোর ছয়টা থেকে সারাদিন বিভিন্ন বাড়িতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল ঘনিয়ে যায়। ততক্ষণে চুলায় কোনো গ্যাস পান না। আবার সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারের কোনো সামর্থ্যও তাদের নেই। এমন অবস্থায় শহরে থেকেও মাটির চুলায় কাজ সারতে হয় বেলা করে ফেরা এই মানুষগুলোকে। আবার গরমকালে যখন পানির চাহিদা বেড়ে যায়, তখন তীব্র পানি সঙ্কট এসব বস্তির নিয়মিত চিত্র।

বাংলাদেশে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ধনী-গরিব বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এই তালিকায় বাংলাদেশের সামনে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত রয়েছে। বাকি তিনটি দেশ হলো নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া।

>> আরও পড়ুন: নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব 

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে শহর এলাকায় মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আরও সহজ করে বললে শহরের পাঁচজনের মধ্যে একজনই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করেন এবং শহরের অর্ধেক পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রটেকশন পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে গ্রামে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি প্রায় ২৬ শতাংশ হলেও টিকে থাকার লড়াই শহরে দরিদ্রদের মধ্যেই বেশি। এর কারণ গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পান। যেখানে শহরের দরিদ্রদের এই সুবিধা পাওয়ার হার বেশ সীমিত, মাত্র ১১ শতাংশের মতো।

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে বস্তির এই মানুষগুলো গ্রাম ছেড়ে শহরে এলেও সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। গ্রামের চাইতে শহরে আরও বেশি টানাপড়েনের জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। শহরে থাকার কারণে খরচ বেড়ে গেছে। শহরে তো পানিটা পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। নিম্ন আয়ের এই মানুষেরা প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন যাপন করে থাকেন।

>> আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধে গ্রামীণ নারী

নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান হবে বিশ্বে তৃতীয়। যাদের কাছে এক থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার আছে তাদেরকে ধনী হিসেবে ধরা হচ্ছে। যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে তারা দুর্নীতি, অনিয়ম, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান ইত্যাদি উপায়ে করে থাকে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, অবৈধভাবে টাকা পাচারকারীরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এর বেশিরভাগই শিকার হচ্ছেন নিম্ন মধ্যবিত্তরা। তারা না পারেন রিকশা চালাতে, না পারেন মাছ বিক্রি করতে। সরকারকে জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ধনী-গরিবের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। নতুবা ডিজিটাল বাংলাদেশে এই উন্নয়ন কোনো কাজেই আসবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

জেএম/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর