রোববার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব

ডা. শামীম হায়দার তালুকদার
প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:৫২ পিএম

শেয়ার করুন:

নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব
ফাইল ছবি

একটি উন্নত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের আশায় প্রতিনিয়ত মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। কৃষি জমির স্বল্পতা বা অনুর্বরতা, সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক বিবাদ এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় মানুষ শহরমুখী হয়। গত কয়েক দশকে দেশে ব্যাপক হারে শহরমুখী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩২.২% মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করে[১]। শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ২.৫% যেখানে জাতীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২%। বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকায় ৪০% জনসংখ্যা রয়েছে। অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ২৯%, এবং ৩০৯টি পৌরসভা শহরে ৩১% জনসংখ্যা রয়েছে[২]।

গ্রাম থেকে আসা এসব মানুষের বেশিরভাগই দরিদ্র। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, শহুরে দরিদ্রদের জীবনযাত্রার মান গ্রামীণ দারিদ্রের থেকে খারাপ। এর কারণ স্বল্পমেয়াদী জীবনযাপন, পরিবেশগত বিপদ, সামাজিক বিভেদ, অপরাধে জড়িয়ে পড়া, সহিংসতা এবং দুর্ঘটনা। শহরের নিম্নবিত্ত মানুষেরা সাধারণত বস্তিতে বসবাস করে। জীবনযাত্রার মান সেখানে নিম্ন। মৌলিক চাহিদাগুলো সেখানে নাগালের বাইরে। বস্তির বাসিন্দারা যেসব বঞ্চনার মুখোমুখি হয় তারমধ্যে স্বাস্থ্যের দিকটা থাকে সবার আগে। নিম্নআয়ের শহুরে পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত অপুষ্টি, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্থিতিশীল সামাজিক জীবন ও বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। অধিক মানুষের বসবাসের জন্য শহরাঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকার মতো বড় শহরে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবও বেশি।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: সুস্থ্য জীবনের জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ঢাকা শহরে ভেক্টর-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব, বিশেষ করে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ায় প্রথমবারের মতো ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব ঘটে। ২০০০ সালে প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে প্রতি বছরে ডেঙ্গু ছোট আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটতে থাকে। ২০১৯ সালে এসে সংক্রমণ সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং ১ লাখেরও বেশি ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় [৩]। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই এখনও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা শহরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০২০ সালে এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের হার ছিল (২৩২১.৭/১,০০০,০০০) [৪]।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষিত বায়ু, খেলাধুলা ও পায়ে হাটার স্থানের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং অতিরিক্ত লবণ সমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা, হতাশা ও দুশ্চিন্তা, অনিরাপদ সড়ক ইত্যাদি কারণে ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন অনুসারে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাদানের দায়িত্ব হচ্ছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসমূহের। আইনগত দায়িত্ব পালনের জন্য শহর এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণ, বিশেষ করে দরিদ্র জনগণের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, পুষ্টি বিষয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, আধুনিক কারিগরি, ব্যবস্থাপনা নীতি ও প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন ভাবধারায় সেবা প্রদান, ইত্যাদি প্রহণযোগ্য কার্যক্রমের সমন্বয়ে কৌশলপত্র ২০১৪ প্রণয়ন করা হয়[৫]।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় কার?

[৬]সম্প্রদায়ের সংহতিকে এগিয়ে নেওয়া ও নাগরিক সচেতনতা প্রচার করে থাকেন। কাউন্সিলের প্রধান সদস্য এবং মুখপাত্র হিসাবে কাউন্সিলের স্থানীয় অগ্রাধিকারগুলি সম্পর্কে মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন কাউন্সিলরের মৌলিক ভূমিকা হল সামগ্রিকভাবে তার এলাকার মানুষদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা। সরকারি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে, সার্বিক জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে একজন কাউন্সিলরকে। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারের সক্রিয় সদস্য হিসাবে মেয়র ও কাউন্সিলরদের নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য কিছু বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, সেবার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালানো, জরুরি গর্ভবতী ও প্রসূতি সেবার জন্য মাতৃসদন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা ও ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য গণসচেতনতা বাড়াতে এলাকা ভিত্তিক প্রচারণা চালানো।

অবশ্য শিশুদের পলিও টিকা প্রদান, কোভিড-১৯ সচেতনতা, গণটিকা কর্মসূচি, মশা নিধনের জন্য কীটনাশক প্রয়োগের মতো জনস্বাস্থ্য রক্ষামূলক অনেক কাজই আমাদের জনপ্রতিনিধিরা করছেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রাখছেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ইউএসসিডিসি এর যৌথ উদ্যোগে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও সেফটিনেট বাংলাদেশ নগর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির আওতায় গত ৩০ নভেম্বর, ২০২২ এ রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘মেয়র সংলাপ: নগর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ সমূহ উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তারা দাবি জানায়, কোভিড মহামারিকালে এবং পরবর্তী সময়ের জনস্বাস্থ্য সমস্যা তুলে ধরে প্রতিটি সিটি করপোরেশনে অন্তত একজন করে মহামারি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। এই মতবিনিময় সভা থেকে জানা যায়, ১২টি সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়িত এ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি নগরে একজন করে জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদ সংযুক্ত করা হয়েছে যারা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতিমালা ও কার্যক্রমে সহায়তা করে।

>> আরও পড়ুন: ধর্মদর্শন: মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার

এখানে দেখা যাচ্ছে- জনসাধারণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে মেয়র ও কাউন্সিলর উভয়ের দায়িত্বই জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের লক্ষ্যে কাজ করা। মেয়ররা একটি বড় এলাকার প্রধান হিসেবে নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিশেষ করে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে যাতে স্বল্পবিত্ত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা বঞ্চিত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখবেন। মশা নিধন কর্মসূচী জোরদার করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়ারসহ বিভিন্ন মশাবাহিত রোগের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করবেন। বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য তারা ব্যাপক প্রচারণা চালাবেন। স্বল্প আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণের লক্ষে বস্তিগুলোর আশেপাশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বাড়ানো, জনসাধারণের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এসে সেবা গ্রহণের জন্য প্রচারণা চালানো ও সেবার মান নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। নিজ নিজ এলাকায় শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রচারণা চালাতে কাউন্সিলরদের নির্দেশ দেবেন। জনপ্রতিনিধিদের সঠিক তত্ত্বাবধানে নিশ্চিত হবে নগরের জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সিইও, এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট।

Reference: 1. Urban Primary Health Care Services Delivery- Home Available online: http://uphcsdp.gov.bd/ (accessed on 8 November 2022). 2. CBHC Available online: http://www.communityclinic.gov.bd/urban-health-page.php (accessed on 4 July 2022). 3. Hossain, M.S.; Amin, R.; Mosabbir, A.A. COVID-19 Onslaught Is Masking the 2021 Dengue Outbreak in Dhaka, Bangladesh. PLoS Negl. Trop. Dis. 2022, 16, e0010130, doi:10.1371/journal.pntd.0010130. 4. Nasir, M.; Chowdhury, A.; Zahan, T. Self-Medication during COVID-19 Outbreak: A Cross Sectional Online Survey in Dhaka City. Int. J. Basic Clin. Pharmacol. 2020, 9, 1325–1330, doi:10.18203/2319-2003.ijbcp20203522. 5. UHS.Pdf. 6. Hasan, M.S.; Narattharaksha, K.; Hossain, M.S.; Afrin, N. Stroke and Healthcare Facilities in Bangladesh and Other Developing Countries; IntechOpen, 2022; ISBN 978-1-80355-352-8.

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর