শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সনাতন পদ্ধতিতে বর্জ্য অপসারণে বাড়ছে বায়ু দূষণ

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:১১ এএম

শেয়ার করুন:

সনাতন পদ্ধতিতে বর্জ্য অপসারণে বাড়ছে বায়ু দূষণ

রাজধানীবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বাসাবাড়ির ময়লাসহ রাজধানীতে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। যা অপসারণের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। কিন্তু সনাতন পদ্ধতিতে এসব বর্জ্য অপসারণে হিমশিম খেতে হয় দুই সিটি করপোরেশনকে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ু দূষণ।

যদিও দুই সিটি করপোরেশনের দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমে গতি ফেরাতে চেষ্টা করছেন তারা। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়াসহ সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণে শৃঙ্খলা ফেরার আশা করছেন তারা।


বিজ্ঞাপন


তথ্য মতে, প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ২৪০০ থেকে ২৭০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। মৌসুমি ফলের সময় এর পরিমাণ আরও বাড়ে।

এসব বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনায় দুই সিটি সেই অর্থে আধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করছে না। রাত বাড়লে বর্জ্য অপসারণ শুরু হয়। যা করে থাকেন দুই সিটির নির্ধারিত পরিচ্ছন্নকর্মীরাই। ঝাড়ু দিয়ে প্রথমে তারা ময়লাগুলো জড়ো করেন। সেই ময়লা সংগ্রহ করে নেওয়া হয় নির্ধারিত ল্যান্ডফিলে। যদিও এ পুরো প্রক্রিয়াই অবৈজ্ঞানিক এবং এটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

>> আরও পড়ুন: স্কুলপাড়ায় ধুলার রাজত্ব

ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সড়ক পরিষ্কার রাখতে সিটি করপোরেশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নকর্মীরা প্রায় প্রতিদিনই বর্জ্য একত্র করে সড়কেই তা পুড়িয়ে ছাই করছেন। একইসঙ্গে ঝাড়ু দেওয়ার সময় গাড়ির বাতাসে অনবরত উড়ছে ধুলা। দুই সিটি করপোরেশনের ল্যান্ডফিলে গিয়েও দেখা যায় বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


dm

বর্জ্য পোড়ানো প্রসঙ্গে পরিচ্ছন্নকর্মীরা জানান, কাজের সুবিধার জন্য এবং ঝামেলা কমাতেই তারা এমন কাজ করছেন। রাতে বর্জ্য প্রায়ই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছেন এ কর্মীরা। এতে দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠে আশপাশের পরিবেশ। নাগরিক ভোগান্তির পাশাপাশি হারাচ্ছে বসবাসের উপযোগিতা। দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। বর্জ্য পোড়ানোর এই কাজটি দক্ষিণ সিটিতে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে বলে স্থানীয়রা জানান। অন্যদিকে উত্তর সিটির আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে গিয়েও দেখা যায় বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে।

ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটির হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, লালবাগ, আজিমপুরসহ মোহাম্মদপুরের কিছু অংশে নিয়মিত পোড়ানো হয় সড়কের বর্জ্য। তিন এলাকার অন্তত দশ জন পরিচ্ছন্নকর্মীর সাথে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তাদের দাবি, বর্জ্য পোড়ানো যাবে না এমন কোনো নির্দেশনা নেই তাদের কাছে।

>> আরও পড়ুন: ধুলার রাজ্যে অসহায় রাজধানীবাসী

পরিচ্ছন্নকর্মীরা বলেছেন, সড়কের বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার চেয়ে পুড়িয়ে ফেলাই সহজ ও নিরাপদ। কারণ, এখানকার অধিকাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক। সরাতে গেলে ঝামেলা বাড়ে, সিটি করপোরেশনের গাড়িতে তুলে দিতে হয়। আর পোড়ানো হলে যেখানের ময়লা সেখানেই শেষ।

ইউসুফ নামে এক পরিচ্ছন্নকর্মী ঢাকা মেইলকে বলেন, ময়লা পোড়ানো হয় মূলত ঝামেলা কমাতেই। যে পরিমাণ ময়লা বা প্লাস্টিক মানুষ রাস্তায় ফেলে তার চেয়ে বেশি ফেলে আশপাশের দোকানিরা। তাই শর্টকাট পথ- সড়কের ময়লা সড়কেই পোড়ানো।

ময়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় পথচারীরা বিরক্ত হয় কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউসুফ বলেন, কেউ কেউ আমাদের ওপর বিরক্ত হয়। আমাদেরই বা কি করার আছে? আগেও পোড়াতাম, এখনও পোড়াই।

dscc

ময়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ায় বিরক্ত নুরে জান্নাত নামে এক পথচারী। তিনি নিয়মিত আজিমপুর কবরস্থানের সামনের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আগুনের স্তূপ থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মাস্ক পরে ধুলোবালি থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু এ ধোঁয়া থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, বায়ু দূষণের শীর্ষে ঢাকা। অকটেনসহ বিপজ্জনক জ্বালানির ব্যবহার করা গাড়ি থাকে সড়কে। বর্জ্য পোড়ানোর ফলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

>> আরও পড়ুন: ধুলোবালির দাপটে বছিলাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ

এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের’ (এনসিএ) আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে নিম্নস্তর বা খারাপ পদ্ধতি হলো পোড়ানো। অনেকেই অসচেতনতার কারণে এটি করে থাকেন, যা রাজধানীর সড়কে করা হচ্ছে। বিভাগীয় শহরেও এমন বর্জ্য পোড়ানোর রীতি রয়েছে।

dscc

তিনি আরও বলেন, বর্জ্য পোড়ানোর ফলে যে নিজেদেরই ক্ষতি তা জানাতে হবে, জানতে হবে। একই সাথে এটি একটি অপরাধ- তাও বুঝতে হবে। এছাড়া এভাবে আগুন দিয়ে প্লাস্টিক বা পাতা পোড়ানোয় এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, যাতে বায়ু দূষণ হয়। এই বায়ু দূষণ গাছ-পালা, কীটপতঙ্গসহ মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ায়। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখতে হবে।

>> আরও পড়ুন: বায়ু দূষণে কমছে আয়ু

কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছিল। কিছুদিন ব্যবহারের পর আর তা সড়কে দেখা যায়নি। বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে কেনা কম্প্যাক্টর ভেহিকলসহ এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে বায়ু দূষণ কমবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ওয়ার্ডভিত্তিক অন্তর্বর্তীকালীন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র নির্মাণ করা গেলে নগরবাসীকে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উপহার দেওয়া যাবে।

dscc

বায়ু দূষণ নিয়ে আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ এলাকার বায়ুমান আরও বিপজ্জনক। পুরো জানুয়ারি মাসেই যা গড়ে প্রতিদিন বায়ুমান সূচক (একিউআই) ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার বায়ু দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্যকর ক্লিন এয়ার আইন করতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এই আইন করতে দেয়নি- এই বিষয়গুলোর জবাব নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধ করতে কার্যকর প্রকল্প, নির্মাণ ও নগর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

>> আরও পড়ুন: বায়ু দূষণ রোধে ‘অ্যাকশন’ শুরু

আইপিডি পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, বায়ূ দূষণে শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ই নয়, এতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় ও জিডিপি কমে যায়। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকায় অনাচ্ছাদিত ল্যান্ডস্কেপিং ও সবুজায়নের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বায়ুর মান নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে। বায়ূ দূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতি রোগের চেয়েও ভয়ঙ্কর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব না।

ডিএইচডি/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর