বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বায়ু দূষণে কমছে আয়ু

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

বায়ু দূষণে কমছে আয়ু

রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বাতাস দিনদিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ঢাকার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াটাও শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কয়েকদিন পরপরই শোনা যায় দূষিত শহরের তালিকায় বিশ্বের সব শহরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকা।

বিশেষ করে গত কয়েকদিন ধরে এমন খারাপ অবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। শুধু তাই নয়, ঢাকার পাশের শহর নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরের বাতাসও ঢাকার মতো দূষিত হয়ে উঠেছে। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে দেশের মানুষ।


বিজ্ঞাপন


বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশিরা গড়ে ৭ বছর আয়ু হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষকরা। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইপিআইসি এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) নির্ণয় করে। তার ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইপিআইসি। শুধু তাই নয়, এই সূচকের হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার পাঁচ দেশের চারটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বায়ু মানের হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী ভারতের নয়াদিল্লি।

>> আরও পড়ুন: স্কুলপাড়ায় ধুলার রাজত্ব

ইপিআইসি’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ু দূষণের কারণে বৈশ্বিক গড় আয়ু মাথাপিছু দুই বছর এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গড় আয়ু কমছে পাঁচ বছর করে। গত বছরের জুনে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বের ৯৭ শতাংশ মানুষের বসবাসের স্থানে বায়ু দূষণের মাত্রা সহনীয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের গড় আয়ু কমার ক্ষেত্রে বায়ু দূষণের ভূমিকা তা ধূমপান, এইডস কিংবা সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যদি বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া বায়ু দূষণের সীমা (দূষণকারী কণার পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম) প্রয়োগ করে হিসাব করা হয়, তাহলে দেশে মাথাপিছু গড় আয়ু ৬ বছর ৯ মাস (প্রায় ৭ বছর) করে কমছে। তবে কিছু এলাকায় দূষণ এত বেশি যে সেখানে গড় আয়ু কমার পরিমাণ ৯ বছর।


বিজ্ঞাপন


এদিকে বায়ুদূষণের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা শহরে যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি এবং ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয় তা ১৩৬ শতাংশ বেশি। সিলেটে সবচেয়ে কম দূষণ হচ্ছে বলা হলেও সেখানকার বাতাসও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমানের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি দূষিত।

ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা থেকে ১ শতাংশ দূষণ বাড়লে বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ২০ গুণ বেড়ে যেতে পারে।

>> আরও পড়ুন: ধুলার রাজ্যে অসহায় রাজধানীবাসী

প্রতিনিয়ত দূষিত শহরের তালিকা নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই স্কোর একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়। এমন খারাপ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও পরামর্শ উল্লেখ করা হয় ওয়েবসাইটে। একিউআই স্কোর ১০০ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়। একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ মানুষকে বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ পরিমাণে বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বাংলাদেশের দূষণ-প্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্ণতায় ভুগছেন। যা কম দূষণ আক্রান্ত এলাকার চাইতে বেশি। গবেষণাটিতে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিমাপ করা হয়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিষণ্ণতায় ভুগছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সীরা। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজেদের নির্ধারিত সীমা (প্রতি ঘনমিটারে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ১৫ মাইক্রোগ্রাম) এবং ডব্লিউএইচওর সীমা- দুটোই অতিক্রম করে গেছে। গবেষকরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শিশু ও প্রসূতির অপুষ্টির কারণে গড় আয়ু প্রায় দেড় বছর কমে যাওয়া এবং ধূমপানের কারণে গড় আয়ু দেড় বছর কমে যাওয়ার সঙ্গে বায়ু দূষণে গড় আয়ু কমার তুলনা টেনেছেন। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এই বায়ু দূষণ জীবনকাল সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে ৮ বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন। চট্টগ্রামে আয়ু কমছে সাড়ে ছয় বছর করে।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, অনেকগুলো কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেসব কারণ হচ্ছে, অতিমাত্রায় যানবাহন। এই যানবাহনের কালো ধোয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ইঞ্জিন থেকে কালো ধোয়া বের হয়। বায়ু দুষণের আরেকটা বড় সোর্স হচ্ছে ইটভাটা। বিশেষ করে শীতকালে সব ইটভাটাগুলো সচল থাকে। এতে দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। আরেকটা কারণ হচ্ছে আমাদের ঢাকা শহরে তুলনামূলক জনসংখ্যা অনেক বেশি। মানুষের চলাফেরায় বায়ু দুষণ বেশি হয়। প্রধানত এই তিনটি কারণে বায়ু দূষণ বেশি হচ্ছে। এই বায়ু দূষণের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভুগী হচ্ছে যারা বাইরে বেশি সময় কাটায়। বিশেষত শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের শ্বাসকষ্টের অসুখ আছে মূলত তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগতভাবে চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকাসহ সারাদেশে অবকাঠামো, ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথ মানদণ্ডে প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শনিবার (২৮ জানুয়ারি) আইপিডির উদ্যোগে ‘রাজধানীর বিপর্যস্ত বায়ু: নগরায়নের বিদ্যমান প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক এক পর্যালোচনা সভায় বক্তারা বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ইটভাটার ধোঁয়া, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, অবকাঠামো ও মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো প্রভৃতি কারণে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

>> আরও পড়ুন: ধুলোবালির দাপটে বছিলাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ

আইপিডি পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, বায়ূ দূষণে শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ই নয়, এতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয় ও জিডিপি কমে যায়। বায়ু দূষণ কমাতে নগরের অনাচ্ছাদিত এলাকায় ল্যান্ডস্কেপিং ও সবুজায়নের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বায়ুর মান নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে। বায়ূ দূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও ভয়ঙ্কর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব হবে না।

বায়ু দুষণ নিয়ন্ত্রণে ৯টি প্রস্তাব দিয়েছে আইপিডি। প্রস্তাবগুলো হলো- সব ধরনের নির্মাণ (অবকাঠামো ও ভবন) কর্মকাণ্ড কঠোর নজরদারিতে আনা। ঢাকার পরিবেশ ও নগরের ভারবহন ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণে কার্যকর ও যথাযথ নিয়ন্ত্রণ। অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি নির্ধারণের মাধ্যমে শুধু ‘অতি জরুরি’ ও ‘দূষণে ন্যূনতম প্রভাব রাখবে’ এমন শ্রেণির অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ। অবকাঠামো নির্মাণে যুক্ত ঠিকাদারদের বায়ুমানের নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নীতি গ্রহণ। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় তদারকি এবং ভবনে এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। নগরে মানসম্মত পাবলিক বাস, প্যারা-ট্রানজিট ও গণপরিবহন বৃদ্ধির আশু উদ্যোগ গ্রহণ। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লক ইট ব্যবহারের সরকার ঘোষিত নির্দেশনার বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। ঢাকার চারপাশে পরিকল্পনামাফিক সবুজ এলাকা ও সবুজ বেষ্টনি তৈরি করা। পরিবেশ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং এক্ষেত্রে যথাযথ নজরদারি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা।

টিএই/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর