শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ঐতিহ্যের সাক্ষী পুরান ঢাকার ‘কাপ্তান বাজার’

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

Bazar
পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজোরের কযেকটি দোকানের পণ্য সম্ভার। ছবি- ঢাকা মেইল
# প্রতিদিন হাজারো ক্রেতার আগমন ঘটে
# পাইকারি ও খুচরা দামে সামান্য পার্থক্য
# যানজট ও ভিড় এখন বড় সমস্যা
# সবজি থেকে ইলেকট্রনিক সব পণ্য মেলে
# বর্ষাকালে দুর্বল হয়ে পড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা 
# ‘কাপ্তান’ নাম মুসলিম পোশাক থেকে

পুরান ঢাকা মানেই ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তেমনই এক ঐতিহ্য কাপ্তান বাজার। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাজার পণ্য কেনাবেচার অতি সুপরিচিত জায়গা। শুধু তাই নয়, পুরান ঢাকার মানুষের জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে এই বাজারের বসবাস।


বিজ্ঞাপন


কাপ্তান বাজারের ইতিহাস ঢাকা গড়ে ওঠার সময় থেকেই শুরু। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে যখন সদরঘাট ঘিরে জমে উঠেছিল বাণিজ্যের কেন্দ্র, তখনই আশপাশের এলাকায় ব্যবসার জন্য গড়ে ওঠে ছোট ছোট বাজার। সেই ধারাবাহিকতায় কাপ্তান বাজারের জন্ম। 

‘কাপ্তান’ শব্দটি এসেছে মুসলিম অভিজাতদের ব্যবহৃত এক ধরনের পোশাক থেকে। একসময় এখানে মূলত কাপড় ও পোশাকের ব্যবসা হতো। ধীরে ধীরে তা প্রসারিত হয়ে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছে।

K2


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে কাপ্তান বাজারে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে কেনাকাটা করতে। সকালে সবজি, মাছ, মাংস, চাল-ডাল বিক্রি হয়, দুপুরের দিকে বাড়ে কাপড়, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানে ভিড়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বাজার থাকে জমজমাট। রমজান মাসে এখানে কেনাকাটার চাপ বাড়ে কয়েকগুণ। ইফতারি তৈরির উপকরণ, দই-মিষ্টি, বেগুনি, হালিম, জিলাপি—সবকিছুর গন্ধে তখন পুরো এলাকা ভরে যায়।

বাজারের ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, এটি কেবল বাণিজ্যের স্থান নয়, পুরান ঢাকার জীবনের প্রতিচ্ছবি। বিক্রেতা ও ক্রেতার সম্পর্ক এখানে অনেকটা পারিবারিক। তারা একে অপরকে নাম ধরে চেনে, খোঁজখবর নেয়। অনেক দোকানই কয়েক প্রজন্ম ধরে চলছে। এসব দোকান এখন শুধুই ব্যবসা নয়, ইতিহাসের অংশ।

তবে কাপ্তান বাজারের বর্তমান চিত্র আগের মতো নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের পরিধি বেড়েছে, কিন্তু জায়গা একই রয়ে গেছে। ফলে এখন এখানে যানজট, ভিড়, আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকীর্ণ রাস্তা, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পুরনো অবকাঠামোর কারণে বর্ষাকালে বাজারে হাঁটাচলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা কাদা আর নোংরায় ভরে যায়।

K3

স্থানীয়রা মনে করেন, বাজারের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে এর উন্নয়ন জরুরি। বাজারের পুরনো স্থাপনাগুলো সংস্কার, রাস্তা প্রশস্তকরণ, পর্যাপ্ত আলো ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে এই বাজার আবারও পুরান ঢাকার মূল বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ফিরে আসতে পারে।

কাপ্তান বাজার পুরান ঢাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এখানে সকালে বিক্রেতারা দোকান খোলে আজানের ধ্বনি শুনে, দুপুরে চায়ের দোকানে আড্ডা জমে, সন্ধ্যায় ক্রেতাদের কোলাহলে গলি ভরে যায়। উৎসবের সময় বাজারের রূপই বদলে যায়। ঈদ, শবে বরাত, পহেলা বৈশাখ কিংবা অন্য যেকোনো উপলক্ষে এখানে মানুষের ভিড় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তখন শুধু কেনাবেচা নয়, আনন্দও ভাগাভাগি হয় সবার মধ্যে।

কাপ্তান বাজারে একসময় হাতের কাজের কাপড় তৈরি হতো, বিদেশ থেকে ব্যবসায়ী আসতেন পণ্য কিনতে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজও টিকে আছে। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক কিছু বদলে গেছে। নতুন নতুন দোকান, আধুনিক পণ্য, উন্নত সাজসজ্জা—সব মিলিয়ে কাপ্তান বাজার আজ এক নতুন রূপে হাজির। কিন্তু তার ঐতিহ্যের শিকড় এখনো পুরান ঢাকার মাটিতেই গেঁথে আছে।

K5

পুরান ঢাকার পরিচয় ধরে রাখার জন্য কাপ্তান বাজার এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, সামাজিক যোগাযোগের জায়গাও। এখানে প্রতিদিনের লেনদেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো মানুষের জীবিকা, গল্প, স্মৃতি। এই বাজার পুরান ঢাকার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগস্থল।

আজও ভোর হলে কাপ্তান বাজার জেগে ওঠে। দোকান খোলে, দর কষাকষি শুরু হয়, ক্রেতাদের হাঁকডাকে বাজার মুখর হয়ে ওঠে। দিনের শেষে কেউ লাভে খুশি, কেউ আবার ক্ষতির হিসাব গোনে। কিন্তু পরের দিন আবার সবাই ফিরে আসে। কারণ এই বাজারই তাদের জীবন, এই বাজারই পুরান ঢাকার প্রাণ। 

সময় বদলাচ্ছে, কিন্তু কাপ্তান বাজারের গুরুত্ব এখনো অটুট। উন্নয়ন, সংস্কার ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এটি শুধু পুরান ঢাকার নয়, পুরো রাজধানীর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে থাকতে পারবে আরও বহু বছর।

K6

রাজধানীর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র কাপ্তান বাজার ক্রেতাদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে সবকিছু এক জায়গায় পাওয়া যায় এ কারণে। এখানে পাওয়া যায় রান্নাঘরের সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, মোবাইল ও কম্পিউটার উপকরণ, বস্ত্র, হোম ডেকোর, গিফট আইটেম এবং ছোট ব্যবসার জন্য ট্রেডিং সামগ্রী। বাজারটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় মূল্য সাপেক্ষতা এবং পণ্যের বৈচিত্র্যের কারণে।

ক্রেতারা জানান, কাপ্তান বাজারে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে প্রযুক্তি, গৃহসজ্জা ও হ্যান্ডিক্রাফট সবই সহজলভ্য। এখানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যের পার্থক্য কম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা বড় সুবিধা পান।

বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রায় প্রতিটি দোকানে নতুন পণ্য নিয়মিত যুক্ত হয়, যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। এছাড়া এখানকার মূল্যমান অন্য বাজারের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ক্রেতারা একসঙ্গে অনেক জিনিস কিনতে পারেন।

K7

কাপ্তান বাজারকে বিখ্যাত করেছে তার সহজ যানবাহন যোগাযোগ এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সহজে পৌঁছানোর সুবিধা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতাদের পদচারণায় বাজারে জমজমাট থাকে। ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন ও বৈচিত্র্যময় পণ্যের আগমন, যা ক্রেতাদের আকর্ষণ ধরে রাখে।

স্থানীয় ক্রেতা আবুল হাসান জানান, কাপ্তান বাজারে দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হোম ডেকোরেশন এবং শিক্ষামূলক উপকরণ—সবই পাওয়া যায়। এক জায়গায় সব পণ্য পাওয়ায় আমাদের সময় ও খরচ দুটোই বাঁচে।

বাজারের ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন বলেন, আমরা পাইকারী ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেই। ছোট ব্যবসায়ীরা এখানে বড় মাপে সরবরাহ ও বাণিজ্যিক সমাধান পান, যা অন্যান্য বাজারে পাওয়া যায় না।

K9

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাপ্তান বাজার ঢাকার ক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ক্রেতারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেতে পারেন এবং ব্যবসায়ীরা নতুন বাজার ও গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে পারেন। এছাড়া এখানে হালাল এবং মানসম্মত পণ্যের প্রচলন, নিরাপদ লেনদেন ও বহুমুখী পণ্যের অভিজ্ঞতা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। 

কাপ্তান বাজার ঢাকার বাণিজ্যিক জীবনকে প্রাণবন্ত রাখে এবং দৈনন্দিন ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনের জন্য অপরিহার্য কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই বাজারে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা সমানভাবে সুবিধা পান। ফলে ঢাকার অন্যান্য বাজারের তুলনায় আলাদা ও প্রিয় স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই বাজার।

এএইচ/এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর