একসময় রাজধানীর গাবতলী আন্ডারপাস ছিল হাজারও মানুষের নিরাপদ চলাচলের অন্যতম ভরসাস্থল। ব্যস্ত সড়ক পার হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পথচারীরা এই আন্ডারপাসটি ব্যবহার করতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু বর্তমানে আন্ডারপাসটি অব্যবস্থাপনা, নোংরা, দুর্গন্ধ ও অনিরাপদ হওয়ার কারণে মানুষের কাছে ভয়ের জায়গায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষের অমনোযোগ ও অবহেলার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এখন দুর্ভোগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিনের মধ্যভাগে সরেজমিনে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ ফুট উঁচু ডিভাইডারের রেলিং টপকে রাস্তা পার হচ্ছেন। অথচ সড়কের নিচ দিয়েই নিরাপদে পার হওয়ার সুযোগ রয়েছে আন্ডারপাসে। কিন্তু আন্ডারপাসে নামলেই ভেসে আসে অসহনীয় দুর্গন্ধ, জায়গায় জায়গায় জমে আছে পচা পানি, বাতিগুলো ভাঙা, ভেতরে অন্ধকার, চারদিকে মশা-মাছির উপদ্রব। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, আন্ডারপাসের প্রবেশপথগুলো দখল করে রেখেছে ভাসমান মানুষ ও অস্থায়ী দোকানপাট। চারপাশে ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। ভেতরে মশা-মাছির ঝাঁক, দুর্গন্ধে ভরা পরিবেশ। ড্রেনের ময়লা পানি জমে আছে দীর্ঘদিন ধরে, সেখানেই ময়লা পচে অসহনীয় দুর্গন্ধের সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে পথচারীরা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না। বাইরে পরিবেশও একইভাবে নোংরা। দেয়ালে প্রস্রাবের দাগ, আবর্জনার স্তূপ, চারদিকে গা ছমছমে দুর্গন্ধ—সব মিলিয়ে আন্ডারপাসে নামা এখন মানুষের কাছে দুর্ভোগের শামিল।
পথচারীরা বলছেন, একসময় যে আন্ডারপাসটি নিরাপদ চলাচলের আশ্রয়স্থল ছিল, এখন সেটি আতঙ্কের জায়গায় পরিণত হয়েছে। দিনে-দুপুরে ভেতরে ঢোকাও ভয়ানক মনে হয়। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই, বাতিগুলো বছরের পর বছর নষ্ট পড়ে আছে, আর দুর্গন্ধে টিকেই থাকা যায় না।
নগরবাসী বলছেন, এভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিত্যক্ত হয়ে পড়া দুঃখজনক। প্রতিদিন হাজারো যাত্রী ও শ্রমিক এখানে যাতায়াত করেন, কিন্তু তাদের জন্য কোনো নিরাপদ বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তারা বলছেন, নোংরা পানি, মশা, দুর্গন্ধ—সব মিলিয়ে এটা এখন যন্ত্রণার জায়গা।
বিজ্ঞাপন

পথচারী কামাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, গাবতলী আন্ডারপাস এখন মানুষের জন্য নয়, দুর্ভোগের জায়গায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই পথ দিয়ে যাতায়াত করলেও কেউ এর যত্ন নিচ্ছে না। আন্ডারপাসে নামলেই পচা পানির দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে, জায়গায় জায়গায় জমে থাকা কাদা ও আবর্জনায় হাঁটার উপায় থাকে না। আলো না থাকায় দিনেও ভেতরটা অন্ধকার, মশা-মাছির উপদ্রবের কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা অসম্ভব।
এই পথচারী মনে করেন, দীর্ঘদিনের অবহেলায় আন্ডারপাসটি এখন অপরাধপ্রবণ ও অনিরাপদ এলাকায় পরিণত হয়েছে। রাতে সেখানে ছিনতাই ও অসামাজিক কার্যকলাপের আশঙ্কা বাড়ছে।
তিনি আরও জানান, পথচারীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপরের রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছেন, কারণ আন্ডারপাস ব্যবহার মানেই অস্বাস্থ্যকর ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা। তার দাবি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত আন্ডারপাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ আবারও স্বাচ্ছন্দ্যে এটি ব্যবহার করতে পারে।
স্থানীয় দোকানদার মোজাম্মেল হোসেন ঢাকা মেইলকে জানান, ভেতরের দুর্গন্ধ, ময়লা ও নোংরার কারণে কেউ আর নিচ দিয়ে যেতে চায় না। সারাদিন মানুষ ডিভাইডার টপকে রাস্তা পার হয়, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়েছে। আন্ডারপাসের চারপাশে জমে থাকা আবর্জনা ও পচা পানির গন্ধ দোকানদারদেরও ভোগাচ্ছে। এতে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে, ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও দীর্ঘদিনের অবহেলায় আন্ডারপাসটি এখন পরিত্যক্ত জায়গায় পরিণত হয়েছে।
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাতি মেরামত ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করলে এখানে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরবে না। স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে এটি পুরো এলাকাজুড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও দুর্গন্ধের জায়গা হয়ে থাকবে।

পরিবহন শ্রমিক রুবেল ঢাকা মেইলকে বলেন, আন্ডারপাসে নামলেই দাঁড়ানো যায় না। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে, পানি জমে থাকে, হাঁটার মতো জায়গা নেই। ইটভর্তি বস্তা ফেলে অস্থায়ী সেতুর মতো বানানো হয়েছে, সেখান দিয়ে মানুষ এক সারিতে হেঁটে যায়। তার ভাষায়, এত কষ্ট করে নোংরার মধ্যে দিয়ে হাঁটার চেয়ে বরং রেলিং টপকে রাস্তা পার হওয়া সহজ।
কুড়িগ্রাম থেকে আসা যাত্রী জয়নব বেগম বলেন, আন্ডারপাসটা ভূতের বাড়ির মতো লাগে। ভেতরে বাতি নেই, অন্ধকার, দেয়ালে প্রস্রাবের দাগ, নোংরা পানি জমে আছে। এ অবস্থায় ভেতরে নামতেই ভয় লাগে। তার অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর এবং ভীতিকর।
শুধু রুবেল বা জয়নব নন, প্রায় সব যাত্রীই একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, আন্ডারপাস ব্যবহার মানেই অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বিষয়টি বারবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে জানানো হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রতিদিন যাতায়াতের সময় এই দুরবস্থার কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
গাবতলী এলাকায় দোকান চালানো ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রতিদিন এই দুর্ভোগ চোখের সামনে দেখি। কতবার অভিযোগ করা হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আন্ডারপাস সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্ডারপাসে শুধু ছোটখাট মেরামতের কাজ করা হয়েছে, তবে বড় কোনো সংস্কার হয়নি। তারা বলেন, শিগগিরই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্ডারপাসটিকে রেগুলার মেইনটেন্যান্সের আওতায় আনা হবে। ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সিটি করপোরেশন আশা করছে, নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলে পথচারীদের চলাচলে ভোগান্তি অনেকটাই কমে আসবে।

এ বিষয়ে মতামত জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদরা বলছেন, এ ধরনের অবহেলা জনস্বাস্থ্য ও নগর জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। জমে থাকা নোংরা পানি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশকবাহিত রোগ ছড়াতে পারে। দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চলাফেরা করা মানুষজনের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
স্থপতি মাহমুদুল হাসান ঢাকা মেইল বলেন, ‘আন্ডারপাসগুলো মূলত মানুষের নিরাপদ চলাচলের জন্য তৈরি হয়। কিন্তু সেগুলো যদি অস্বাস্থ্যকর থাকে, মানুষ ব্যবহার করবে না। তখন মানুষ বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ডিভাইডার টপকে রাস্তা পারাপার করবে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। তাই অবিলম্বে আন্ডারপাস পরিষ্কার করা, আলো সচল রাখা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মাহমুদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা ওই এলাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যানবাহন চলাচল করে, এখন এটা চলাচল উপযোগী না হলে আমাদের জন্য দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। আমরা যদি আন্ডারপাস ক্লিয়ার করার সময় দেশের বৃষ্টির মাত্রা ও দৈনন্দিন কাজগুলো মাথায় রেখে কাজ না করি, তাহলে সমস্যা থেকেই যাবে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির পানি ঢুকছে—এসব বিবেচনায় রেখে ডিজাইন করা উচিত। কারণ এখানে বৃষ্টির পানি ঢুকছে, তাই দেখতে হবে ডিজাইন করা যাবে কি না, কেন হচ্ছে এবং এর সলিউশন বের করতে হবে। এগুলো না করলে উপর দিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। এগুলো গ্রহণ করতেই হবে, তার জন্য ডিজাইন সলিউশন দরকার। এর পাশাপাশি এগুলোর ক্ষেত্রে ডিজাইন হয়েছে কি না, সেগুলো চেক করে দেখা দরকার।’

আদিল মাহমুদ খান বলেন, ‘সাধারণত এসব ডিজাইন তৈরি করে রাখা উচিত। এখন যদি এগুলোর ডিজাইন ফোল্ডার না থাকে, তাহলে কষ্টকর হয়ে যাবে, আবার খরচেরও বিষয় আছে। আসলেই এখানে দৃষ্টিপাত করা দরকার—কেন পানি জমেছে, তার জন্য একটা সলিউশন দরকার। যারা এগুলোর পর্যবেক্ষণে ছিল, সেগুলো টার্গেট করা দরকার। এই ডিজাইনগুলো দেখে আপৎকালীন সমস্যাগুলোর সমাধান বের করা যায়। এখানে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা যদি দীর্ঘমেয়াদে কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, তাহলে এগুলো সমাধান করা সম্ভব। তবে এসব সমস্যাকে নিজেরা থেকেই ইন্ডিকেট করে রাখা দরকার।’
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গাবতলী আন্ডারপাস উদ্বোধন করা হয়। তখন সৌন্দর্যবর্ধন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্ডারপাসটি চালু হয়েছিল। শুরুতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ব্যবহার করতেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।
এএইচ/জেবি

