রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত মুক্তাঙ্গন, যা এক সময় রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্থানটি রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের দখলে। এক সময় এই পার্কটি রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং এবং গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে প্রাণচঞ্চল ছিল। জিরো পয়েন্ট থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা এখন গাড়ি পার্কিং, দোকানপাট ও অবৈধ স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দখলদারিত্বের কারণে নাগরিকদের জন্য পার্কটি ব্যবহারযোগ্য জায়গা হিসেবে আর থাকছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, মুক্তাঙ্গনের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার। ফুটপাতজুড়ে ছোটখাটো দোকানপাট এবং মসজিদও গড়ে ওঠেছে। ভাঙারির আড়ত এবং অন্যান্য স্থাপনা পার্ককে নাগরিকদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। পেছনের অংশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্থাপন করা ময়লার কন্টেইনারও দেখা যায়। প্রতিদিন উপচে থাকা ময়লার কারণে পার্কের ভেতরে কাদা জমে যায়, যা পার্কের মূল কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। নাগরিকরা জানান, এক সময় খোলা মাঠ ও সবুজ পরিবেশের মধ্যে যে মিছিল-মিটিং হতো, তা এখন সম্পূর্ণ বন্ধ।
বিজ্ঞাপন
রেন্ট-এ-কার ব্যবসায় মুক্তাঙ্গনের ব্যবহারের নিয়ম হলো সমিতির সদস্য হওয়া। সদস্য হতে প্রথমে নির্দিষ্ট অর্থ দিতে হয় এবং পরে মাসিক ফি রয়েছে। এই অর্থ স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতাদের ‘ম্যানেজমেন্ট’ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষেও একইভাবে গাড়ি রাখার ব্যবসা চলছে। সেখানে মাসিক চাঁদার হার তুলনামূলকভাবে কম। স্থানীয় সমিতি সদস্যরা জানান, যখন কোনো অভিযান বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা থাকে, তখন তারা আগে-ভাগেই ব্যবস্থা নেন। এতে গাড়ি সরিয়ে নেওয়া বা কোনো ধরনের বিরক্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
আরও পড়ুন
খাল হারিয়ে ‘বেহাল’ ঢাকা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নোহা গাড়িচালক বলেন, ‘আমরা এখানে সমিতির নিয়ম মেনে গাড়ি রাখি। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট টাকা জমা দিতে হয়, যা দিয়ে সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করা হয়। জায়গাটা মূলত খোলা মাঠ ছিল, কিন্তু এখন গাড়ি ছাড়া রাখা যায় না। আমরাও চাই জায়গাটা সুন্দর থাকুক, কিন্তু জীবিকার জন্য আমাদের গাড়ি রাখতেই হয়। সরকার বিকল্প ব্যবস্থা করলে আমরা নিজেরাও এই জায়গা খালি করতে রাজি আছি।’
বিজ্ঞাপন

অন্য এক গাড়িচালক বলেন, ‘আগে এখানে গাড়ি রাখতে গেলে অনেক বেশি টাকা দিতে হতো। সমিতির নামে আলাদা চাঁদা, আবার বিভিন্ন জায়গায় আলাদা খরচ ছিল। এখনো টাকা দিতে হয়, তবে আগের মতো চাপ নেই। মাসিক একটা নির্দিষ্ট ফি জমা দিলেই সমিতি বিষয়টা দেখে। মাঝে মাঝে অন্য খাতে খরচ হলেও সেটা আগের তুলনায় কম। আগে আমাদের জন্য এখানে গাড়ি রাখা কষ্টকর ছিল, এখন কিছুটা সহজ হয়েছে।’
মুক্তাঙ্গন ও আশপাশে ফুটপাতের বেশির ভাগ এখন দোকানপাটে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারীদের মতে, ফুটপাতে অগোছালো দোকান বসানো এবং গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে মানুষ চলাফেরা করতে পারছেন না। মূল রাস্তায় গাড়ির পার্কিং জোনগুলোর কারণে যানজটও বেড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় যেখানে খোলা মাঠ ও বসার জায়গা ছিল, সেখানে এখন গাড়ি, দোকান ও অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন
পুরো দেশের ভার টানছে ঢাকা!
মুক্তাঙ্গন এক সময় পল্টন ময়দানের বিকল্প হিসেবে সভা-সমাবেশের কেন্দ্রস্থল ছিল। এরশাদের সময় পল্টন ময়দান থেকে মিছিল-মিটিং সরিয়ে মুক্তাঙ্গনে আনা হয়। বহু রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি এখান থেকেই শুরু হতো। তবে সময়ের পরিবর্তনে এবং দীর্ঘদিনের অবহেলার কারণে মুক্তাঙ্গনের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। নাগরিকরা এবং রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, এটি পুনরুদ্ধার না হলে ঢাকায় মানুষের মত প্রকাশের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হারিয়ে যাবে।
মুক্তাঙ্গনের পাশ ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে ডাস্টবিন এবং ভাঙারির দোকান। সেখানে প্রতিদিন উপচে থাকা ময়লা পার্কের চারপাশে কাদা তৈরি করছে। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, মূল সড়কে কন্টেইনার রাখা সম্ভব না হওয়ায় এটি পার্কে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প চালু হলে এগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। ভাঙারির দোকানগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক সমর্থকদের মাধ্যমে ভাড়া নেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে পার্কের ব্যবহারের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে গেছে।

নগরবাসী বলছেন, মুক্তাঙ্গনের পরিবর্তিত চিত্র নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের দখল, চাঁদাবাজি এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া কাটিয়ে পার্কটি জনগণের জন্য ব্যবহারযোগ্য হচ্ছে না। ঐতিহাসিক মুক্তাঙ্গন পার্ক আবার তার প্রাচীন পরিচিতি ফিরে পাবে বলে আশা করছেন তারা। যেখানে আবার মানুষ বিনা বাধায় সভা-সমাবেশ, মিছিল এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে।
মুক্তাঙ্গনের পাশের ফুটপাতও এখন প্রায় সবই দোকানপাটে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারীদের মতে, ফুটপাতে হেঁটে চলা প্রায় অসম্ভব। নাগরিকরা জানান, একসময় যেখানে খোলা মাঠ এবং বসার জায়গা ছিল, এখন তা গাড়ি পার্কিং, দোকানপাট এবং ময়লার জন্য ব্যবহার হচ্ছে। ফলে পার্কের মূল চরিত্র আর দৃশ্যমান নয়।
প্রবীণ রাজনীতিবিদরা বলছেন, মুক্তাঙ্গনের সামনের অংশে সারিবদ্ধভাবে রাখা গাড়ি পার্কিং জোন ও রেন্ট-এ-কার ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। স্থানীয়রা মনে করেন, নগরবাসীর চাহিদা ও পার্কের প্রকৃত ব্যবহার অনুযায়ী প্রশাসনের হস্তক্ষেপ না হলে পার্কটি সবুজায়ন এবং মানুষের জন্য উন্মুক্ত করার কাজ ব্যাহত হবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মুক্তাঙ্গন তৈরির সময় উদ্দেশ্যটি যথার্থ ছিল, তবে জায়গাটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। সভা-সমাবেশ হলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত, তাই তেমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এখন যদি স্থানটি সংস্কার করে সভা-সমাবেশের জন্য ব্যবহার করা যায়, তবে তা অনেক ভালো হবে। অন্যথায়, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট ও দক্ষিণ গেটে যে সভা-সমাবেশগুলো হয়, সেখানে জায়গা কম হওয়ায় রাস্তা ও যানজটের কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি ঘটে। তাই সভা-সমাবেশের জন্য বিকল্প কোনো স্থান করা অত্যাবশ্যক।’

মান্না বলেন, ‘মুক্তাঙ্গন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়নি, যার ফলে ‘রেন্ট-এ-কার’ প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে দখল নিয়ে ব্যবহার করছে। এটি একটি পরিচিত স্থান। যদি কর্তৃপক্ষ এখানকার ব্যবহার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে, তবে এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হবে। যেসব মানুষ উচ্ছেদ হওয়ার পর পুনরায় এখানে দখল নিচ্ছে, তার কারণ হলো তাদের পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত স্থান নেই। তাদের জন্য বিকল্প পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলে তারা সেখানেই যেতে পারবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিকরা মুক্তাঙ্গনকে আর স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তারা এখন প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ বা বক্তব্য প্রদান করতে অভ্যস্ত। তাই মুক্তাঙ্গন বা অন্য কোনো স্থান নিয়ে যদি পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে তা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে যে ঐতিহাসিক স্থানগুলো রয়েছে, সেগুলো আসলে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো স্বাধীনতার সংগ্রামের স্থান হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এই স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এগুলো বিশ্বের মান অনুযায়ী সুন্দরভাবে সংরক্ষণ ও সাজানো উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব স্থানকে অর্থনৈতিক বা ভাড়ার নামে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি এক ধরনের অবমাননা।’
এই নগরবিদ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। অথচ বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরে এই স্থানগুলো অবহেলিত রয়েছে। কেউ এগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে, কিন্তু সরকারি পর্যায় থেকে কোনো কার্যকর নজরদারি বা পরিকল্পনা দেখা যায় না। নগর পরিকল্পনার দিক থেকে এ স্থানগুলোকে সংশোধন ও পুনঃসংস্কারের প্রয়োজন। পাশাপাশি, এই স্থানগুলোকে রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবিদারদের দ্বারা ব্যবহার করা না হয়, সেই বিধান ও নীতি তৈরি করা দরকার।’
তিনি অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই বিষয়গুলোতে উদাসীন। আমাদের দেশে অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে যেখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ব্যবহারবিধি এবং নীতিমালা নির্ধারণ করতে হবে। এই স্থানগুলোতে যখন কোনো প্রোগ্রাম হবে না, সাধারণ মানুষ জানতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যাবে।’

আদিল মোহাম্মদ খান আরও বলেন, ‘এ ধরনের স্থানগুলোকে যারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে, তাদের কর্মকাণ্ড তদন্ত করা উচিত। এটা স্পষ্ট করা দরকার, কারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তারা কোন বিষয়ে দায়ী। বর্তমান সরকারকে অবশ্যই এসবের পেছনে থাকা চক্র চিহ্নিত করতে হবে। অতীতের বিভিন্ন সরকারি দলের লোকেরা এসব স্থানকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, কিন্তু নতুন সরকার দেশ সংস্কারে মনোযোগী। এখনই সময়, যখন সরকার বর্তমান পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।’
জানা গেছে, রেন্ট-এ-কার ব্যবসার কারণে পার্কের পূর্বের খোলা জায়গা ও ব্যবহারযোগ্য অংশ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে। পার্কের সামনের রাস্তা রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীদের জন্য দখল করা। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে সাধারণ নাগরিক ও পথচারীদের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একসময় যেখানে খোলা মাঠ ও সবুজ পরিবেশ ছিল, সেখানে এখন গাড়ি ও দোকানপাটে জায়গা দখল হয়ে গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমানের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্পত্তি বিভাগে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন মারুফা বেগম নেলী। তার সাথে কথা হলে তিনি এ বিষয়ে অবগত নন বলে জানিয়েছেন। পরে বিস্তারিত বলার পরে তিনি বললেন, আমি সবেমাত্র জয়েন করেছি, আমার এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। আপনারা লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এএইচ/জেবি

