ঢাকা শহরের ব্যস্ত সড়কে ফুটওভার ব্রিজের সমস্যা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। ভাঙা সিঁড়ি, আলোর ঘাটতি, হকারদের দখল ও অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ পথচারীদের জন্য প্রতিদিনই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় অনেক পথচারী সচেতনভাবে ব্রিজ ব্যবহার না করে সরাসরি রাস্তা পার হওয়াকে বেছে নিচ্ছেন। এতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে মোট ৭৪টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে, যার মধ্যে ৪৩টি ডিএনসিসি এবং ৩১টি ডিএসসিসি এলাকায়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানায়, নগরীর ব্যস্ততম স্থানে নতুন করে ৩৬টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ৮টিতে থাকবে চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর। কাকলী, শাহীন কলেজ, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিএমএইচ হাসপাতাল, শ্যামলী ইন্টারসেকশন, মহাখালী অঞ্চল-৩ এবং প্রগতি সরণির ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এগুলো বসানো হবে। এই ৮টি স্থানে ২টি করে মোট ১৬টি চলন্ত সিঁড়ি বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান ৪৭টি ফুটওভার ব্রিজ সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে।
বিজ্ঞাপন
ডিএনসিসির দাবি, নতুন ব্রিজ এবং চলন্ত সিঁড়ি বসানো হলে পথচারীরা নিরাপদে সড়ক পার হতে পারবে এবং দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। পথচারীদের সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। চলন্ত সিঁড়ি বসানোর ফলে মানুষ বসেই রাস্তা পার হতে পারবে। নতুন ব্রিজের সঙ্গে আমরা যাত্রী ছাউনিও তৈরি করছি, যাতে ভিড় ও যানজটের মধ্যেও মানুষ অপেক্ষা করতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে একশটিরও বেশি ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তাদের অনেকটাই ব্যবহার উপযোগী নয়। ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৯৩টি ব্রিজ থাকলেও এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাঙা, নোংরা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত। হকার, গৃহহীন ও অবৈধ দোকানদারদের দখলে। এই অবস্থায় অনেক পথচারী বাধ্য হয়ে ব্যস্ত সড়ক পারাপার করছেন।
শুক্রাবাদ ব্রিজ প্রায় দেড় বছর ধরে আলোহীন। সন্ধ্যার পর কেউ সেখানে ওঠার সাহস পায় না। পান্থপথের ব্রিজ বর্জ্য ও আবর্জনায় ভরে আছে, গৃহহীন ও মাদকসেবীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবের ব্রিজে ছাদ নেই, সিঁড়ি ভাঙা এবং বৃষ্টির সময় এটি পিচ্ছিল হয়ে যায়, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। নিউ মার্কেট চাঁদনী চক এলাকার পুরাতন ব্রিজ ভেঙে ফেলার পর দীর্ঘ সময় ধরে নতুন নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করছেন।
বিজ্ঞাপন

শাহবাগের ব্রিজ ফুল বিক্রেতাদের দখলে। সিঁড়ি নোংরা ও ভাঙা, ফলে শিক্ষার্থী ও রোগীরা সমস্যায় পড়েন। বলাকা সিনেমা হলের ব্রিজে সন্ধ্যার পর ছিনতাইকারীরা ঘন ঘন আসে। মৎস্য ভবনের ব্রিজটি দখল হয়ে আছে গৃহহীনদের হাতে, যা মানুষদের ব্যবহার করতে বাধ্য করে না।
চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর থাকা সত্ত্বেও তা সচল নয়। বনানী, বিমানবন্দর, ফার্মগেট ও যমুনা ফিউচার পার্ক সংলগ্ন ব্রিজে এস্কেলেটর থাকলেও বেশির ভাগ সময় অচল থাকে। বিদ্যুতের সমস্যা, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি ও খরচের অজুহাতে এগুলো কার্যত অকেজো হয়ে গেছে। ফলে পথচারীরা এগুলো ব্যবহার করতে পারছেন না। সচল থাকলে চলন্ত সিঁড়ি জীবনকে অনেক সহজ করে দিত, কিন্তু বন্ধ থাকায় এগুলো এখন বোঝা ছাড়া কিছু নয়।
ফুটওভার ব্রিজগুলো দখল হয়েছে হকার, ভিক্ষুক ও গৃহহীনদের হাতে। প্রায় প্রতিটি ব্রিজে ছোটখাটো দোকান বসেছে, যেখানে হাঁটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রাতে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতির ভীতি সবসময় থাকে। পুলিশ টহল থাকলেও তা অল্প সময়ের জন্য, পরে আবার ব্রিজগুলো দখল হয়ে যায়।
শুক্রাবাদ, পান্থপথ, সায়েন্স ল্যাব ও নিউ মার্কেটের ব্রিজগুলো ভাঙা সিঁড়ি, জমে থাকা পানি, অল্প আলো এবং হকারদের দখলের কারণে পথচারীদের ঝুঁকিতে ফেলে। রমনা পার্ক, আসাদ গেট, পরীবাগ, নটরডেম কলেজ ও বাংলাবাজারের ফুটওভার ব্রিজগুলোও প্রায় পরিত্যক্ত।
ফার্মগেট, মিরপুর-১০, মিরপুর-১, কাকলি এবং বনানীতে ব্রিজ ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও এগুলোর বেশির ভাগ বিক্রেতাদের দখলে। ফলে মানুষ নিরাপদ ব্রিজ ব্যবহার করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নতুন ব্রিজ নির্মাণ যথেষ্ট নয়; পুরনো ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম সমান্তরালভাবে চালানো প্রয়োজন।
ঢাকার ব্যস্ততম মোড়গুলোতে জে-ওয়াকিং বা অবৈধ রাস্তা পারাপার রোধ করতে পুলিশের অভিযানও চলছে। ডিএমপি ও বিআরটিএ নিয়মিত কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম, সচেতনতা ক্লাস এবং জরিমানা কার্যক্রম চালিয়ে পথচারীদের ব্রিজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে এ ধরনের কার্যক্রমের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবার পর্যায়েও জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।

পথচারীদের অভিজ্ঞতাও ভয়াবহ। তারা বলছেন, হকারদের কঠোরভাবে উচ্ছেদ এবং সবার জন্য চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন হলে ব্রিজ ব্যবহারের হার অনেক বাড়বে। এছাড়া বিশেষভাবে প্রতিবন্ধী ও বয়সজনিত সীমাবদ্ধতার মানুষদের জন্যও সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ফুটওভার ব্রিজ সচেতনতা কার্যক্রম ও অবকাঠামো উন্নয়নের সমন্বয়ে ঢাকার সড়কে যাত্রীরা নিরাপদে পারাপার করতে পারবে, দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে এবং সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। নতুন নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পথচারীদের দৈনন্দিন যাতায়াতের নিরাপত্তা ও সুবিধা নিশ্চিত হবে। এভাবেই ঢাকা শহরের ফুটওভার ব্রিজের ব্যবহার ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ চলছে। ট্রাফিক আইন, জনসচেতনতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সমন্বয়ে শহরজুড়ে নিরাপদ পারাপার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শুক্রাবাদ ব্রিজের পাশের একজন দোকানদার জানান, রাত হলে ছিনতাইকারীরা ঘন ঘন আসে। আলো না থাকায় মানুষ উপরে উঠতে সাহস পায় না। শাহবাগে এক শিক্ষার্থী বললেন, ব্রিজে উঠলেই দুর্গন্ধ ও ভিক্ষুকদের ভিড়ে হাঁটা যায় না, বরং ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়াই সহজ। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক নাসরিন সোহানা বলেন, কিছু ব্রিজের অবস্থা এমন যে সুস্থ মানুষও পার হতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে।
আরও পড়ুন
পুরো দেশের ভার টানছে ঢাকা!
ঢাকার ব্যস্ত মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা থাকলেও বাস্তবে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শাহবাগ মোড়ে এক ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল বলেন, যদি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের গুরুত্ব জিজ্ঞাসা করা হয়, সবাই জানে এটি নিরাপদ, তবুও ব্যস্ত রাস্তায় উপরে উঠতে অনিচ্ছুক। এটি মূলত অভ্যাস ও অযত্নের কারণে।
শিকড় পরিবহনের চালক আবেদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার জন্য সব সময় চালকদের দোষ দেওয়া যায় না। রাস্তা পার হওয়া ব্যক্তিরা হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে এলে চালকরা সময়মতো প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হন, যা দুর্ঘটনার কারণ হয়। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করলে যানজট ও বিপদের ঝুঁকি কমবে।

এই চালক আরও বলেন, যখন ট্রাফিক সিগন্যাল খোলা থাকে, তখন দ্রুত পারাপারের জন্য চালকরা তাড়াহুড়ো করেন। তবে পথচারীরা ব্রিজ ব্যবহার করলে ঝামেলা এবং দুর্ঘটনা কমে।
এদিকে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত 'ঢাকা শহরে ফুটওভারপাস ও আন্ডারপাসের দক্ষতা' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার ৮৬ শতাংশ পথচারীর কারণে ঘটে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ৪৬.৬ শতাংশ পথচারী ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস ব্যবহার করেন, বাকি ৫৩.৪ শতাংশ ব্যবহার করেন না। সবচেয়ে কার্যকর ওভারপাস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ফার্মগেট ওভারপাস, যেখানে যাতায়াত হার ৯৪ শতাংশ। অপরদিকে, গুলিস্তান আন্ডারপাসে পথচারী ব্যবহার মাত্র ১৭ শতাংশ।
পথচারীদের সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জরিপে দেখা গেছে, ৫০০ জনের বেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৯৪ শতাংশ মনে করেন, জনসচেতনতা ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার নিশ্চিত করার মূল কারণ।
এ কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছে। ডিএমপি ও বিআরটিএর উদ্যোগে যারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সরাসরি রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের জন্য এক ঘণ্টাব্যাপী সড়ক সচেতনতা ক্লাস চালানো হচ্ছে। এতে অংশগ্রহণকারীরা ট্রাফিক আইন ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত লিফলেট ও মৌখিক নির্দেশনা গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রম শহরের বিভিন্ন ব্যস্ত স্থানে নিয়মিত পরিচালনা করা হয়।
ফুটওভার ব্রিজের ব্যবহার বৃদ্ধিতে চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর স্থাপন জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তরে চলতি সময় ৩৬টি নতুন ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে ৮টি ব্রিজে মোট ১৬টি চলন্ত সিঁড়ি বসানো হবে। এস্কেলেটর স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে জনবহুল এলাকা ও হাসপাতাল, কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। যেমন, কাকলী, শাহীন কলেজ, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, সিএমএইচ হাসপাতাল, শ্যামলী ইন্টারসেকশন, মহাখালী অঞ্চল-৩ এবং প্রগতি সরণি।
এছাড়া বিদ্যমান ৪৭টি ব্রিজের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে, যাতে এগুলো ব্যবহার উপযোগী ও নিরাপদ হয়। চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের পাশাপাশি ব্রিজের কাঠামো মজবুত করা, আলোর ব্যবস্থা করা এবং হকার ও অবৈধ দোকানদারদের উচ্ছেদ করা গুরুত্বপূর্ণ। পথচারীদের সুবিধার্থে ৫০টি নতুন ছাউনি স্থাপন করা হবে এবং সড়ক মিডিয়ান ও ফুটপাতের পাশে ৪৫টি গ্রিল বেড়া দেওয়া হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, ঢাকা শহরের ফুটওভার ব্রিজের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত এবং এটি শুধু পথচারীর নিরাপত্তার সমস্যা নয়, বরং শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাতেও বড় প্রভাব ফেলছে। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ব্যস্ত সড়কগুলোতে ফুটওভার ব্রিজের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। পথচারীদের অভ্যাস ও সচেতনতা বৃদ্ধিও সমান্তরালভাবে জরুরি। পরিকল্পনাবিদদের বক্তব্য, ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর স্থাপন করলে প্রবীণ ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সহজে ব্যবহার করতে পারবে, যা ব্রিজের ব্যবহার বাড়াবে। এছাড়া হকার, অবৈধ দোকানদার ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে নিয়মিত তদারকি এবং সিসিটিভি নজরদারি কার্যকর করতে হবে।
তাদের মতে, ফুটওভার ব্রিজের অবস্থার কারণে পথচারীরা প্রায়ই সরাসরি রাস্তা পার হতে বাধ্য হচ্ছেন, যা দুর্ঘটনার মূল কারণ। নতুন ব্রিজ নির্মাণের পাশাপাশি পুরনো ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। জনসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে ব্রিজ ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। ব্যস্ত মোড় ও হাসপাতাল, কলেজ এলাকা, বাজারের আশেপাশে চলন্ত সিঁড়ি ও নিরাপদ প্রবেশ পথ তৈরি করলে পথচারীরা ঝুঁকি কমিয়ে নিরাপদে পারাপার করতে পারবে। পরিকল্পনাবিদরা আশাবাদী যে, নগরের পরিকল্পিত উদ্যোগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ঢাকা শহরের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের ফুটওভার ব্রিজগুলো যেগুলো চলন্ত সিঁড়ি আছে, সেগুলো দুই একটা বাদে দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ। যখন এ ধরনের স্থাপন করা হয় তখন এর পথ, পরিকল্পনা ও মেরামতের ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলোর জন্য একটি সক্রিয় ব্যবস্থা থাকা দরকার, যেটা আমাদের দেশের গবেষণার ধরণ অনুযায়ী সবসময় উপযোগী কি না—সেটা আগে বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। কিন্তু সেই ধাপগুলো যথাযথভাবে আগে করা হয়নি, প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণও করা হয়নি। ফলে চলন্ত সিঁড়িগুলো ভেতরে না করানোর কারণে অধিকাংশই অকেজো হয়ে গেছে।
এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, আসলে যেকোনো পরিকল্পনা তখনই কার্যকর হয় যখন স্থানীয় প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ থাকে এবং তারা বিষয়গুলো নিতে পারে। এখানে যারা প্রতিষ্ঠান আছে তারা যেন এগুলোর উপযোগী ব্যবহারের দিকটা বোঝে—এটা স্বীকারোক্তি আকারে গ্রহণ করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেসরকারি সংস্থাগুলোও সেটা করতে পারেনি। এতে দেখা গেছে অনেক টাকা খরচ করে যেগুলো করা হয়েছিল তা এখন অকার্যকর হয়ে গেছে।
তার মতে, ঢাকার মতো শহরের রাস্তাগুলোতে এই ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম নাগরিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলোকে আমাদের ফুটপাত ও সুযোগ-সুবিধায় সহজভাবে ব্যবহারযোগ্য করতে হবে। একইসঙ্গে যেসব সড়ক সংকেত রয়েছে সেগুলোও কার্যকর করার জন্য সঠিকভাবে ঠিক করা দরকার।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, শহরের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তারা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, নতুন ব্রিজ নির্মাণ এবং বিদ্যমান ব্রিজের সংস্কার-উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা উত্তরে ৩৬টি নতুন ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে ৮টিতে চলন্ত সিঁড়ি বসানো হবে। এছাড়া বিদ্যমান ৪৭টি ব্রিজ সংস্কার করা হবে। চলন্ত সিঁড়ি ও ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে পথচারীদের পারাপার নিরাপদ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

ফুটওভার ব্রিজে হকার ও অবৈধ দোকানদারের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জরুরি এলাকায় পুলিশ সহযোগিতায় নিয়মিত তদারকি চালানো হচ্ছে। এছাড়া রাতের অন্ধকারে সড়ক ও ব্রিজ আলোকিত করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলেন, ব্রিজের পাশে যাত্রী ছাউনির নির্মাণ, সড়ক মিডিয়ান উন্নয়ন ও ফুটপাতের পাশে গ্রিল বেড়া স্থাপনও পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ।
তারা জানান, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও সিটি করপোরেশনের অগ্রাধিকার। বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা কর্মসূচি, লিফলেট বিতরণ ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে পথচারীদের মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যেসব পথচারী ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সরাসরি রাস্তা পারাপার করার চেষ্টা করে, তাদের জন্য এক ঘণ্টাব্যাপী সচেতনতা ক্লাস আয়োজন করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন, এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা বাড়বে, দুর্ঘটনা কমবে এবং ফুটওভার ব্রিজের ব্যবহার বাড়বে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ঢাকা মেইলকে বলেন, নগরবাসীর সুবিধার্থে ইতোমধ্যেই নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, চলন্ত সিঁড়ির যন্ত্রপাতি দেশের ভেতরে সহজলভ্য না হওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণেই মেরামতের কাজে কিছুটা সময় লাগছে। তবে ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হাতে পাওয়া মাত্র দ্রুত মেরামতকাজ শুরু হবে। এরপর পথচারীরা আবারও নির্বিঘ্নে এক্সলেটর ব্যবহার করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রশাসক আরও জানান, রাজধানীতে নতুন করে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। আগের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের কাজও ধাপে ধাপে শুরু হবে। এতে নগরবাসীর জন্য নিরাপদ সড়ক পারাপারের সুযোগ আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, ফুটওভার ব্রিজের ওপর যে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বসে থাকে তা নিয়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব দোকান পথচারীদের চলাচলে বড় ধরনের অসুবিধা তৈরি করে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। বিষয়টি সমাধানে ইতোমধ্যেই কাজ চলছে। আগামী মাসের মধ্যে এর ফলাফল দৃশ্যমান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মোহাম্মদ এজাজ।
এএইচ/জেবি

