বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

হাসিনার নৈশভোটের কুশীলব কারা, নাম এলো ক’জনের?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১১ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাতের ভোটের ঘটনা এখনো দেশের ইতিহাসে এক বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। সেই নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে যেভাবে নির্বাচনী কারচুপি চালায়, তা দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে— রাতে ভোট গ্রহণের জন্য যেসব সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতারা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন তদন্তের আওতায় আসছেন।

নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, জেলা প্রশাসনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তারা রাতের ভোটের আয়োজন ও বাস্তবায়নে অংশ নেন। এসব কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল এমন, যে কেন্দ্রে যত ভোটার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভোট কেটে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, ভোটের ফলাফল এমনভাবে পাল্টে দেওয়া হয়েছিল, যেন প্রকৃত ভোটারের সংখ্যার সাথে কোনো সম্পর্কই না থাকে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যখন দেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনা হয়, তখন হাসিনা সরকার তা উপেক্ষা করে, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা নেয়। বিশেষত, তাদের পদোন্নতি এবং প্রশংসাপত্র ‘থ্যাংকস লেটার’ দেওয়া হয়।


বিজ্ঞাপন


গণঅভ্যুত্থানের পর, ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের নানা অবিচারের তদন্ত শুরু হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকেই নানা অভিযোগ ওঠে, তবে তদন্তের নতুন ঝড় শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের রাতের ভোটের বিষয় নিয়ে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে— পুলিশে, প্রশাসনে এবং নির্বাচন কমিশনে যারা রাতের ভোটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই তালিকায়, সবচেয়ে বেশি নাম রয়েছে পুলিশ সদস্যদের। ওই তালিকায় সাবেক আইজিপি, পুলিশের ইউনিটপ্রধান, ডিআইজি, এসপি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, থানার ওসি, ইন্সপেক্টরসহ অনেক পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। পাশাপাশি, ৩৬৪ জন জেলা প্রশাসক ও ইউএনওর নামও রয়েছে, যারা রাতের ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এছাড়া, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবদের নামও উঠে এসেছে এই তালিকায়। এমনকি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও রাতের ভোটের কারিগর হিসেবে পরিচিত। তদন্তের জন্য যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তা ইতিমধ্যেই সরকারের শীর্ষ মহলের কাছে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন
যেভাবে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে পুলিশ

পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, নির্বাচন শেষ হওয়ার পর, রাতের ভোটে জড়িত ১৫ জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বিদেশে পালিয়েছেন। তারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, দুবাই, তুরস্ক ও ভারতে অবস্থান করছেন। গত বছর ১ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০১ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন এক ডিআইজি, সাত অতিরিক্ত ডিআইজি, দুই পুলিশ সুপার, এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পাঁচ সহকারী পুলিশ সুপার এবং আরও অনেক পুলিশ সদস্য।


বিজ্ঞাপন


পাশাপাশি, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা গা ঢাকা দিয়েছেন, এবং বিভিন্ন কারণে তারা এখনো তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসেননি। তালিকা অনুযায়ী, ৪৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা গরহাজির এবং ৩৯ জন পুলিশ সদস্য অন্য কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন।

পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, উপ-মহাপরিদর্শক ও জেলা পুলিশ সুপাররা বিশেষভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। তারা পদোন্নতি এবং ভালো স্থানে পদায়ন পেয়েছেন।

তবে, তদন্তের অংশ হিসেবে এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, এবং দুদক তাদের অগোছালো সহায়-সম্পদ খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেছে।

নির্বাচনের পরপরই, পুলিশ সদর দফতর থেকে সংশ্লিষ্ট সব পুলিশ কর্মকর্তা এবং ইউনিটপ্রধানদের ‘থ্যাংকস লেটার’ পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে নির্বাচনে তাদের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছিল, এবং বলা হয়েছিল যে তারা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। চিঠি পাওয়ার পর, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অবাক হয়েছিলেন, কারণ তারা জানতেন যে রাতের ভোট ছিল সযত্নে পরিকল্পিত কারচুপি।

এরপর, তদন্তে জানা গেছে যে রাতের ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত সরকারের উচ্চপর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল। বিশেষভাবে, পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই এর নেতৃত্ব দিয়েছিল। এমনকি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রাতের ভোটে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। সেই সময়ের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং তার নীতিনির্ধারকরা নিজে বৈঠক করে রাতের ভোটের পরিকল্পনা করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা রাতের ভোটের সহায়তায় জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অনেকেই একযোগভাবে ভোট কারচুপির জন্য কাজ করেছিলেন।

এছাড়া, সম্প্রতি দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে।

পুলিশ সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনের আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জরিপ করেছিল, যেখানে আওয়ামী লীগের জন্য ২২ থেকে ৩০টি আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, বাকি আসনে বিএনপি, জামায়াত এবং অন্য দলগুলোর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে, নির্বাচনের পর রাতের ভোটের মাধ্যমে সেই পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া হয়েছিল।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এই ক্যাটাগরির আরও খবর

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর