গণআন্দোলনের মুখে সরকারের পতনের পর ঢেলে সাজানো হচ্ছে প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ডিএমপি কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালকসহ কয়েকটি শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর তাতেই আতঙ্ক বাড়ছে পুলিশে। বিশেষ করে যারা বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করেছেন তাদের মধ্যে আতঙ্কটা বেশি। এসব কর্মকর্তাদের অনেকে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। বাকি যারা আছেন তারাও বেশ ভয়ে আছেন। কখন কাকে ওএসডি বা বদলি করা হয় সেই আতঙ্কে আছেন তারা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুতে শান্তিপূর্ণ অবস্থা থাকলেও একপর্যায়ে তা সহিংতায় রূপ নেয়। কয়েকদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষে চার শতাধিক মানুষ নিহত হন। আহত হন কয়েক হাজার। তীব্র আন্দোলনের মুখে গত সোমবার দুপুরে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে দেশের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সরকারপ্রধানের দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা। পুলিশের গুলিতে মারা যান অনেকে মারা যান।
বিজ্ঞাপন
এমন সহিংসতার পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে গেলে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। এরপর আইজিপিসহ বাহিনীটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের একের পর এক বদলি করা হয়। আর তাতে আতঙ্ক বাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটির মধ্যে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে দেখা যায়নি ডিএমপির আলোচিত সাবেক ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আকতার, ড. খ মহিদ উদ্দিন, যুগ্ম কশিমনার বিপ্লব কুমার সরকারকে। কেউ কেউ ফোন বন্ধ করেছেন। আবার কেউ বাসার পরিবর্তে অন্যত্র সরে আছেন।
আরও পড়ুন
জানা যায়, বিগত সময়ে যারা সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তারা এখন হয় ওএসডি অথবা অন্যত্র বদলি হবেন। তবে কাউকে আপাতত চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগরীর একজন সহকারী উপ পুলিশ কমিশনার বলেন, রদবদল শুরুর পর ডিএমপির ঊর্ধ্বতনের দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত সোমবার থেকে ডিএমপির প্রায় দেড় শতাধিক কর্মকর্তা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আলোচনায় থাকা কর্মকর্তারা এখন সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছেন বলেও জানান তিনি।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সবেমাত্র রদবদল শুরু হলো। আরও হবে। পর্যায়ক্রমে পুলিশকে ঢেলে সাজানো হবে। কারণ পুরাতনরা যেভাবে চালিয়েছে তার জন্য আজকে পুলিশের এত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে শুরু হলো। এখন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতেও ঊর্ধ্বতনদের বদলি করা হবে। পরে সেসব জায়গায় যোগ্য ও সৎ অফিসারদের বসিয়ে দেওয়া হবে।
পুলিশের এই সহকারী উপপুলিশ কমিশনারের মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে গত ১২ বছরে তিন হাজারের বেশি অফিসারকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, যাদের কোনো অপরাধ ছিল না।
চাকরিচ্যুত হওয়া সাবেক একজন ওসি বলেন, ‘আমার তো কোনো অপরাধ ছিল না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় না থাকায় আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়। কোথায় এখন সেই অফিসাররা। আজকে পুলিশে বিপদে তারা গর্তে লুকিয়েছে। ভয়ে কেউ আর বড় বড় অফিসারদের কলও করছেন না, কল ধরছেনও না। তারা যাই করুক না কেন ছাড় পাবে না।’
জানা যায়, পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রদবদলের পর ডিএমপির ঊর্ধ্বতনরা ছাড়াও ৫৩ থানার ওসিও আতঙ্কে আছেন।
আরও পড়ুন
সোমবার রাতে ডিএমপির এক থানার ওসিকে ফোন করা হলেও তিনি ঠিকভাবে কথা বলেননি। শুধু এটুকু বলেছেন, এই মুহুর্তে কথা বলার মতো পরিবেশ নেই। এ কথা বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।
এছাড়া আরও কয়েকজন এডিসি ও এসি লেভেলের কর্মকর্তাদের কল করা হলেও তাদের কেউ ফোন ধরেননি। এরপর মেসেজ দিলেও তারা উত্তর দেননি।
মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কয়েকজন উপপরিদর্শক (এসআই) সহিংসতায় পুলিশ সদস্যদের হতাহতদের জন্য ঊর্ধ্বতনদের দুষছেন।
তারা বলেন, আজকের পরিস্থিতির জন্য ঊর্ধ্বতনরা দায়ী। সরকারকে টিকিয়ে রাখতে গুলি করার নির্দেশ দিয়ে তারাই বিপাকে ফেলেছেন পুলিশ সদস্যদের। এজন্য তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেন তারা।
ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যেসব কর্মকর্তা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে ফায়দা লুটেছেন থানায় ঢুকে হামলা চালানোর সময় সাহায্যর জন্য কল করা হলেও তারা ফোন ধরেননি। এসব কর্মকর্তার নামের তালিকা হচ্ছে। নতুন আইজিপি এ বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআইকে/এমআর