সাদিক এগ্রোর ১৫ লাখ টাকার ছাগল এক লাখ টাকায় বুকিং দিয়ে ডেলিভারি নেননি মুশফিকুর রহমান ইফাত। বিষয়টি সামনে আসার পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে। ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এগ্রো ফার্মে কোরবানির পশু বুকিং দিয়ে শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করার অভ্যাস ইফাতের নতুন নয়। ২০২১ সাল থেকে এ ধরণের ঘটনা নিয়মিত ঘটিয়ে আসছেন তিনি।
আলোচিত-সমালোচিত ইফাতের বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করতে এই প্রতিবেদক বৃহস্পতিবার (২০ জুন) দুপুরে যান রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকায়। সেখানে ইফাতের বিষয়ে কোনো ইতিবাচক তথ্য মেলেনি। তবে তার বিষয়ে জানা গেছে কিছু অজানা তথ্য।
বিজ্ঞাপন
গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় এড়িয়ে স্থানীয় এক যুবকের কাছে ইফাত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এক কথায় বলেন, ‘ও তো চরম লেভেলের একটা বেয়াদব। বাবার টাকা আছে তো, সেই গরম ওর মধ্যে সব সময় দেখবেন।’
এই যুবক বলেন, ‘নিউজে এখন যা যা আসছে, তা আমরা আগে থেকেই জানি। নিউজে ও ফেসবুকে ওর একটা গাড়ি দেখানো হচ্ছে ক্রাউন। এছাড়াও ওর গাড়ি আছে। একটা প্রাডো আছে, একটা প্রিমিও আছে। মোট গাড়ি চারটা। কোনো গাড়িই ৫০ লাখ টাকার কমে নাই। তবে ওর গাড়ি ওর কাছে কম থাকে, অন্যদের কাছে বেশি থাকে। ও একটা চালায়। বাকিগুলো এলাকার বড় ভাই, বন্ধু-বান্ধবের কাছে থাকে।’
তিনি জানান, সাদিক এগ্রোর ছাগল কাণ্ডের আগে ইফাত এ ধরণের ঘটনা আরও অনেক ঘটিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর সাদিক এগ্রো থেকে ছাগল কেনার জন্য বুকিং দিয়ে না নেওয়ার পাশাপাশি একই ঘটনা ঘটেছে গরুর ক্ষেত্রেও। তবে সেটা অন্য খামারে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছর ইফাতের গরু ও মহিষ বুকিং দেন কেরানীগঞ্জের বুড্ডু ক্যাটেল ফার্ম ও আল আফরাজ ক্যাটেল ফার্ম থেকে।
সত্যতা যাচাই করতে শুক্রবার (২১ জুন) এ প্রতিবেদক যান কেরানীগঞ্জ উপজেলার হিজলা এলাকায় বুড্ডু ক্যাটেল ফার্মে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, এবার দুইটি গরু ও একটি মহিষ বুকিং দিয়েছিলেন ইফাত। গরু দুটি নিলেও রয়ে গেছে মহিষটি।
বুড্ডু ক্যাটেল ফার্মের ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দুইটা গরু নিছে। একটা ছোট, আরেকটা বড়। আমরা গিয়ে ধানমন্ডিতে দিয়ে আসছি। মহিষ একটা বুকিং ছিল। বাসায় নাকি জায়গা নাই, তাই মহিষটা নেয় নাই।’
খামারটির ভেতরে দেখা মেলে কালো রঙের বিশালদেহী মহিষটির। তবে এটির দাম কত হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি তিনি। বলেন, ‘দামটা আসলে আমাদের বস ঠিক করেন। আমি জানি না। তিনি দেশের বাইরে গেছেন।’
চলতি বছরের বাজার দর অনুযায়ী ধারণা করলে, মহিষটির দাম কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা হতে পারে।
এদিকে এ বছর কেরানীগঞ্জেরই আরেক খামারিকে আড়াই লাখ টাকা লস গুনিয়েছেন ইফাত। আল আফরাজ নামের ওই খামারের মালিক মো. শুভ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার থেকে একটা গরু নেবে বলে এক লাখ টাকা অ্যাডভান্স করেছিল। গরুর দাম ছিল সাত লাখ টাকা। একেবারে ঈদের ৫ থেকে ৬ দিন আগে এসে বলতেছে সে নিবে না, টাকা নাই। আমাকে অন্য কোথাও বিক্রি করে ফেলতে বলে। ওই সময় আমি কোথায় বিক্রি করব? পরে সাত লাখ টাকার গরু আমি সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করি।’
এই খামারি বলেন, ‘আমার কাছে এই বছরই সে প্রথম আসে। পরে জানতে পারি, ওর গরু লাগে ৬ থেকে ৭টা। কিন্তু বুকিং দেয় ১৩ থেকে ১৪টা। বাকিগুলো সব শেষ মুহূর্তে এসে ক্যান্সেল করে।’
এ বছর আরও একটি গরু বুকিং দিয়ে সেটি পরে বাতিল করেন ইফাত। ঘটনাটি ঘটেছে ঈদের দুই মাস আগে জাতীয় প্রাণিসম্পদ মেলায়। বরিশাল থেকে আসা একটি গরু কেনার জন্য বুকিং দিয়েছিলেন ইফাত। পরে সেটি বাতিল করেন।
রাজধানীর আরও একটি খামারে টানা তিন বছর একই ঘটনা ঘটিয়েছেন মুশফিকুর রহমান ইফাত। চলতি বছর ওই খামার থেকে একটি গরু নিয়ে কোরবানিও দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, তিন থেকে চার বছর আগে ইফাত তখন বেশ ছোট। একটি সাইকেলে চেপে খামারে আসতেন তিনি। গরু দেখে পছন্দ করতেন। গরুও কিনতেন। আদরের সন্তান হওয়ায় তার পছন্দকেও গুরুত্বও দিতেন পরিবারের অন্যরা।
জানা গেছে, প্রতি কোরবানিতে ইফাতের ধানমণ্ডির বাসায় কোরবানির জন্য ৬ থেকে ৭টি গরু নেওয়া হয়, যা শুধু তার পরিবারের পক্ষেই কোরবানি করা হয়।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে খামার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে এই খামার থেকে গরু বুকিং দিয়ে শেষ সময়ে তা বাতিল করেছিলেন ইফাত। বয়সে ছোট হওয়ায় তার প্রতি বিরূপ আচরণ করেননি কোনো খামারি। তবে বেশ কয়েকজন খামারির সঙ্গে বাজে ও অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে কথা বলার অভিযোগও আছে মুশফিকুর রহমান ইফাতের বিরুদ্ধে।
রাজধানীর একজন খামারি পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি নিজে ইফাতের বাসায় গিয়েছি। তার বাবাকে আমি চিনি। এখন তার বাবা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে কম না। ইফাতও যে কথা বলছে, ইমরান ভাই (সাদিক এগ্রোর মালিক) তাকে দিয়ে ভিডিও করিয়েছে প্রচারের জন্য, এটাও একটা অনর্থক কথা। ইমরান ভাইর মার্কেটিংয়ের প্রয়োজন নাই। তাতে সবাই চেনে। আমরাও তার হাতে গড়া। আমাদেরও লোকজন চেনে। কোরবানির সময় আমাদের টার্গেট থাকে বিক্রি করা। ১৫ লাখ টাকার একটা ছাগল বিক্রি না করে অযথা ভিডিও বানাতে যাবে, ইমরান ভাই এত বোকা না। ইফাত ছাগলটা কিনেছে। পরে যে আর নেয়নি। ফোন বন্ধ করে রাখে, ম্যাসেজ দেখে না। এটা তার অভ্যাস। আমাদের সাথেও এটা ঘটেছে।’
ইফাতের এই কর্মযজ্ঞ শুধু রাজধানী বা ঢাকার আশপাশে নয়, বন্দর নগরীতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটিয়েছেন। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় খামার হিসেবে পরিচিত সারাহ এগ্রো লিমিটেড। সেখানেও বুকিং করে পরে গরু নেননি ১৯ বছরের এই তরুণ।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. জাবেদ ঢাকা মেইলকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘২০২১, ২০২২ সালে সে আমাদের এখানে আসে। তার বুকিং থাকত ৭ থেকে ৮টা। কিন্তু গরু নিতো ১ থেকে ২টা। বুকিং ক্যান্সেল করত একেবারে শেষদিকে এসে।’
মো. জাবেদ জানান, ইফাতের এ ধরণের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বুঝতে পারার পর প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ তাকে এড়িয়ে যায়। ২০২২ সালের পর সারাহ এগ্রোতে পশু বুকিং করতে পারেননি তিনি।
এদিকে, নিজের চারটি গাড়ির কথা বৃহস্পতিবার (২০ জুন) রাতে নিজেই স্বীকার করেছেন ইফাত। নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কারহাব বিডি নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে নিজের গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন তিনি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, প্রাডো, সিভিস, মাজেসস্তা, প্রিমিও নামে তার চারটি গাড়ি আছে, যা তিনি এক মাসের মধ্যে বিক্রি করতে চান।
ওই বিজ্ঞাপনে তিনি গাড়ি বিক্রি করার কারণও জানান। তিনি লিখেন, তিনি দেশ ছেড়ে কানাডা চলে যাবেন।
মুশফিকুর রহমান ইফাতের ব্যক্তিজীবন
ইফাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলের।
প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা ও ফর্সা গড়নের ইফাতের বয়স ১৯ বছর। বয়স কম হলেও তিনি বিবাহিত। পড়াশোনা করেন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে।
সূত্র জানিয়েছে, ইফাত রাজধানীর নটরডেম কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্র। ইফাত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।
কারই/এমএইচটি