রেড সি ফিল্ম ফেস্টিভালের তৃতীয় সংস্করণের পর্দা উঠল বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়। তারও তিন ঘণ্টা আগে থেকে শুরু হয় লাল গালিচার উন্মাদনা। এ দিন স্থানীয় সময় রাত ৮টায় জেদ্দার রিটজ করল্টন হোটেল অডিটরিয়ামে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে টানা দুই ঘণ্টা চলে লাল গালিচায় তারকা-শিল্পী-কুশলীদের পদচারণা ও ফটোশুট।
দুই ঘণ্টায় রেড সি’র লাল গালিচা মাড়িয়েছেন হলিউড থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্তের সহস্রাধিক শিল্পী ও কলাকৌশলী। এরমধ্যে সর্বোচ্চ করতালি আর উচ্ছ্বাসের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে হলিউড সুপারস্টার জনি ডেপ এবং উইল স্মিথের উপস্থিতিতে। সম্ভবত তারা দুজনই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চারপাশের মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন হাসি মুখে। যতক্ষণ লাল গালিচায় ছিলেন জনি ও স্পিথ, ততক্ষণই মুখে লেগেছিল হাসি। টের পাওয়া গেছে, তাদের দেখে উপস্থিত সবার উচ্ছ্বাস কিংবা শোরগোল উপভোগ করছিলেন দারুণ। ভক্তদের সঙ্গে তার আচরণ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞাপন
তবে লাল গালিচায় ভক্তদের সঙ্গে বেশি মজা করেছেন উইল স্মিথ। অস্কার মঞ্চে তার চড়-কাণ্ডের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে এক ভক্ত প্রিয় তারকার সঙ্গে আলাপ জমানোর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আই অ্যাম ব্যাড বয়’। উইল স্মিথ তখন নিজের গালে হাত দিয়ে বলেন, ‘উই আর টু ব্যাড বয় টু নাইট টুগেদার’।
প্রথম দুই আসরের তুলনায় তৃতীয় সংস্করণে আরব তারকাদের প্রাধান্য বেশি থাকলেও হলিউড অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন, মিশেল উইলিয়াম, রণবীর সিংকে নিয়ে বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীদের আগ্রহ ছিল বেশি।
জনি ডেপ লাল গালিচার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। তবে তিনি মঞ্চে উঠেননি। গত মে মাসে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনি ডেপ অভিনীত ‘জান দ্যু ব্যারি’ সিনেমাটি দেখানো হয়েছিল। ওই সিনেমার অর্থায়ন করেছিল রেড সি ফিল্ম ফাউন্ডেশন। একই ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে তিনি এখন অভিনয় করছেন ‘মোদি’ নামের একটি সিনেমায়। এটি ইতালীয় চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর অ্যামেডিও মোদিগলিয়ানির একটি বায়োপিক। এ নিয়ে চলমান উৎসবের অন্য কোনো প্রোগ্রামে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
রেড সি’র তৃতীয় আসরের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে আরবি ভাষার সিনেমা ‘হাউজান’। সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছে সিনেমাটিতে। সৌদি আরবের জনপ্রিয় লেখক ইব্রাহিম আব্বাসের ‘ওয়াইএ’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে এর চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে। যা পশ্চিমা বিজ্ঞান- কল্পকাহিনী এবং আরবি সংস্কৃতি ও লোককাহিনীতে বেশ সমাদৃত ছিল। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন দুবাই-ভিত্তিক ইরাকি চলচ্চিত্র নির্মাতা ইয়াসির আল ইয়াসিরি। সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌদি অভিনেতা বারা আলেম। তিনি স্নেহময় যুবক জিন চরিত্রে কাজ করেছেন। যিনি একজন তরুণীর (মানুষ) প্রেমে পড়েন। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন উদীয়মান অভিনেত্রী নুর আলখাদরা।
২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরবের অর্থনীতিকে তেল নির্ভরতা থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। তারই অংশ হিসাবে দেশটির সংস্কৃতিক অঙ্গন বিকাশের লক্ষ্যে সিনেমার ওপর থেকে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে। এর মাত্র ৬ বছরের মধ্যে আরব সিনেমা দিয়ে অনুষ্ঠান উদ্ভোধনকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসাবে দেখছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা।
উদ্বোধনীতে নিজের সিনেমা প্রদর্শনী প্রসঙ্গে ইয়াসিন আল ইয়াসিরি বলেন, আমরা এখন সেই শহরে আছি যেখানে এই গল্পটি ঘটে। আমার কাছে পুরো বিষয়কে একটি রূপকথার মতো মনে হচ্ছে। এই অনুভতি বলে বুঝানো যাবে না।
এবার উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় রয়েছে আরব ও আফ্রিকা অঞ্চলের ১৭ টি সিনেমা। তবে উদ্বোধনী সিনেমাটি প্রতিযোগিতার বাইরে রাখা হয়েছে। এবার উৎসবে বিচারকদের সভাপতি হিসাবে কাজ করছেন ‘এলভিস’ খ্যাত পরিচালক বাজ লুহরম্যান। যেখানে আছেন ফ্রিদা পিন্টো, জোয়েল কিন্নামান এবং আমিনা খলিলও। লুহরম্যান বলেন, বিচারক প্যানেলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সৌদি আরবের পটভূমি বোঝার জন্য এখানে সময় কাটিয়েছি। যেখানে ৩০ বছরের বেশি সময় সিনেমা ছিল না। সেখানে হঠাৎ সিনেমা নির্মাণের ঘোষণাকে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিচ্ছেন সেটা দেখার জন্য অনেকটা নিরবেই সৌদিতে এসে ছিলাম। আমি বিভিন্ন স্টুডিওতে গেছি। এখানকার যে বিষয় আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হলো, তরুণ ও উদীয়মান নির্মাতাদের গল্প বলার ক্ষুধা।’ তিনি বলেন, এজন্যই আমি এখানে আছি। যখন রাজনীতি আমাদের ব্যর্থ করে এমন একটি সময়ে গল্পকারদের শুনতে হবে এবং আমরা এখানে সমর্থন করতে এসেছি।
এবার এমন একটি সময় রেড সি ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে যখন ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং হলিউডে অভিনেতাদের ধর্মঘট চলছে। ফলে এবারের উৎসবের প্রথম দিন ‘এ’ তালিকাভূক্ত অতিথির সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। তবে উৎসব চলাকালীন সময়ে তারা হাজির হবেন বলে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।
রেড সি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জোমানা আল রশিদ তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেছেন, আজ রাতে আমরা শুধুমাত্র সৌদি আরব থেকে নয়, আফ্রিকা, এশিয়া এবং সারা বিশ্বের অসাধারণ প্রতিভার উপস্থিতিতে সৌভাগ্যবান। ২০২১ সালে আমাদের ফাউন্ডেশন চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ২৫০টির বেশি চলচ্চিত্রে অর্থায়ন করেছি। এরমধ্যে চলতি বছর অনুষ্ঠিত কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিনেমার মধ্যে ৮টিই ছিল আমাদের লগ্নি করা সিনেমা। করোনা মহামারির পর সৌদি আরবের বক্স অফিসের ব্যবসা দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। আমরা আশা করছি ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এই বাজার বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।’
তার বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রেড সি’র সিইও মোহাম্মদ আল তওকি বলেছেন,মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম বক্স অফিস সহ সৌদি চলচ্চিত্র শিল্প এখন স্বীকৃত একটি শক্তি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সঠিক পথেই আছি।’
তাদের বক্তব্যের পর সৌদি আরবের প্রবীণ লেখক ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল- সাধন’র হাতে সম্মাননা দেওয়া হয়। তিনি দেশটির জনপ্রিয় কমেডি শো ‘তাশ মা তাশ’ দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। এরপরই ডায়ান ক্রোগার’র হাতে আজীবন সম্মাননা তুলেদন তার্কিশ বংশোদ্ভূত জার্মান পরিচালক ফাতিহ আকিন। এরপর বলিউড অভিনেতা রণবীর সিংয়ের হাতে পুরস্কার তুলে দেন শ্যারন স্টোন। রণবীর সিং পুরস্কার হাতে নিয়ে বলেন, পর্দায় আমার সব সময়ের আইডল জনি ডেপ আজ দর্শক সারিতে বসে আছেন। এমন একজন মানুষের সামনে থেকে পুরস্কার পাওয়াটা সত্যিই অনেক গর্বের। রূপান্তর এবং বহুমুখীতার মাস্টার হিসাবে আপনি কারুশিল্প সম্পর্কে আমাকে যা শিখিয়েছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার দ্বারা অনুপ্রাণিত।
অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার ঠিক আগে রেড সি বিচারক মণ্ডলীর সভাপতি লুরম্যান মঞ্চে আসেন। এত দ্রুত সৌদি আরব চলচ্চিত্রে এমন পরিবর্তন নিয়ে আসবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে চিন্তাকে বৈশ্বিক করার কারণে। আপনি যখন সারা পৃথিবীকে নিজের গ্রাম মনে করবেন তখন অনেক কিছুই সহজ করে করা যায়।