বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানে শুধু একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ নয়, স্বপ্নভরা এক দুনিয়াতেও পদার্পণ। এইচএসসির পর শিক্ষার্থীদের বড় স্বপ্নগুলোর একটি হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া।
মেধা আর কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পান, সেসব শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ ভিন্ন রকম এক জগতের সন্ধান পান। নতুন বন্ধু, নতুন সম্পর্ক, রাজনৈতিক তর্ক, ক্যান্টিনের আড্ডা, লাইব্রেরির দীর্ঘ সময়, কিংবা ক্লাসের প্রস্তুতি- সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হয়ে ওঠে জীবনের সেরা সময়ের এক অধ্যায়।
এই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেকটি স্বপ্ন, লাল বাসে চড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিআরটিসির বরাদ্দকৃত লাল বাস শুধুই পরিবহন নয়, শিক্ষার্থীদের আবেগ ও পরিচয়ের প্রতীক। সকালে বন্ধুরা মিলে গাদাগাদি করে সেই বাসে করে ক্যাম্পাসে আসা, আবার ক্লাস শেষে একইভাবে ফেরা- এসব মুহূর্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে একেকটি অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকে।

ঢাবি, জাবি, রাবিতে কিংবা চবিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে কেউ কেউ এই লাল বাসে যাতায়াতের যোগ্যতা অর্জন করে পুলকিত হয়, আবার কেউ কেউ ভর্তির সুযোগ না পেয়ে হাহাকার করে, দূর থেকে তাকিয়ে থাকে সেই লাল বাসের দিকে। তাই এই বাস একদিকে যেমন আনন্দ, অন্যদিকে বঞ্চনার প্রতীকও বটে।
বিজ্ঞাপন
লাল বাসের ইতিহাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল বাস চালুর ইতিহাস বেশ পুরনো। স্বাধীনতার পর শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সহজ করতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিশেষ পরিবহন বরাদ্দ দেয়। সে সময় থেকেই বিআরটিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কিছু বাস চালাতে থাকে। এসব বাসের রং সাধারণত লাল ছিল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘লাল বাস’ নামে পরিচিতি পায়।
প্রথমদিকে বাসের সংখ্যা ছিল সীমিত। কয়েকটি নির্দিষ্ট রুটে সকাল-বিকেল শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করা হতো। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় রুট এবং বাস দুটিই বাড়ানো হয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিদিন কয়েক ডজন লাল বাস বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বাস চলে।

তবে একটি বিষয় হয়তো অনেকেই জানেন না, দ্বোতলা এই বাসগুলো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং বিআরটিসির মালিকানাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিআরটিসির মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ভাড়ায় বাসগুলো শিক্ষার্থীদের পরিবহন সেবা দিয়ে থাকে।
লাল বাস কার? মালিকানা ও অর্থনীতি
শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করেন, বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিনে নিয়েছে। আসলে তা নয়। বাসগুলো পুরোপুরি বিআরটিসির মালিকানাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাসিক বা বাৎসরিক চুক্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট রুটে এই বাসগুলো পরিচালনা করে।
আরও পড়ুন: নামেই পার্ক, বাস্তবে কংক্রিটের মাঠ
বাৎসরিক ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামমাত্র পরিবহন খরচ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সরকার এই সেবাকে শিক্ষাখাতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং ভর্তুকি দেয়। অর্থাৎ, প্রতিটি বাস চলতে যে খরচ হয়- জ্বালানি, চালক, হেলপার, রক্ষণাবেক্ষণ সব কিছুর একটি বড় অংশ সরকার বহন করে।

এখানেই লাল বাসের বিশেষত্ব। এটি বাণিজ্যিক পরিবহন নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধাভিত্তিক একটি সেবা।
শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের প্রথম যে আনন্দগুলোর একটি থাকে তা হলো ‘লাল বাসে ওঠা।’ অনেকেই স্বপ্ন দেখেন, ভর্তির দিনেই যেন লাল বাসে উঠতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি যখন ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টে দেখি ঢাবিতে চান্স পেয়েছি, তখন শুধু পড়াশোনার কথা মাথায় আসেনি, মনে হয়েছিল এবার আমি লাল বাসে উঠতে পারব।’
এই বাসে ওঠা শিক্ষার্থীদের কাছে যেন একটি বিশেষ পরিচয়ের স্বীকৃতি। অন্যদিকে, যারা চান্স পান না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে থাকেন, তারা প্রতিদিন লাল বাস দেখে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পান।

তেমনই একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার কলেজের কয়েকজন বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তারা লাল বাসে ওঠে যায়। আমি প্রতিদিন ওদের দেখি, আমার ওই বাসে উঠার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি।’
লাল বাসের দৈনন্দিন চিত্র
সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসে এই বাসগুলো দিয়ে। সবাই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বাসগুলোতে ওঠে। এছাড়া পথে এসব বাসে উঠার জন্য নির্দিষ্ট রুটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কেউ সিট পায়, কেউ দাঁড়িয়ে যায়।
যাত্রাপথে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, রাজনৈতিক আলোচনা, গান গাওয়া সব কিছুই চলে। অনেকে ক্লাসের নোট পড়েন, কেউবা ঘুমিয়ে নেন। আবার ক্লাস শেষে বিকেলে বাসে ফেরার সময় সবাই ক্লান্ত। কেউ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন, কেউ আবার হাসি-তামাশায় মেতে ওঠেন।
শেষ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘চার বছরে যত স্মৃতি জমেছে, তার অর্ধেকই লাল বাসের। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি, ঝগড়া, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে বাসে ওঠা- সবই আমার জীবনের অমূল্য স্মৃতি।’

সমস্যাবলি ও চ্যালেঞ্জ
লাল বাস যতটা না আবেগের, তার থেকে বেশি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম সমস্যা হলো সংখ্যার স্বল্পতা। প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার জন্য নির্ভর করেন এই বাসগুলোর ওপর। কিন্তু বাসের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম।
এর ফলে সকালবেলায় ক্লাসে যেতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, একটি বাস পূর্ণ হয়ে গেলে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক ডজন শিক্ষার্থী অন্য কোনো পরিবহন ব্যবহার করতে বাধ্য হন, যেখানে তুলনামুলক খরচ বেশি।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় সময়মতো বাস না পাওয়া। সরকারি পরিবহন হওয়ায় অনেক সময় নির্ধারিত রুটে বাস এলেও সময়মতো আসে না। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে দেরি হয়ে যায়। পরীক্ষার দিনে এই সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।
মেয়েদের সমস্যা আলাদা করে চোখে পড়ে। সকালবেলার ভিড়ে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, কখনো কখনো গাদাগাদি অবস্থায় উঠে অস্বস্তি নিয়ে যাত্রা করতে হয়। নিরাপত্তা বা গোপনীয়তার বিষয়টিও তাদের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।

বাসের পুরনো অবস্থাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। অনেক বাস বহু পুরনো, ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। মাঝপথে হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়া, চাকা পাংচার হওয়া, বা ইঞ্জিনে সমস্যা তৈরি হওয়াসহ নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। ফলে যাত্রীরা বিপদে পড়ে যান। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য বিষয়টি বেশ বিব্রতকর।
এর বাইরে আরও আছে প্রতিযোগিতা ও ঠেলাঠেলি। সকালে ভিড়ের সময় বাসে উঠতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি, ঝগড়া এমনকি মারামারির ঘটনাও ঘটে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। কেউ কেউ বলেন, লাল বাসে উঠতে পারলেই যেন অর্ধেক বিজয় সম্পন্ন হয়।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিকল্পনার অভাব। অনেক রুটে বাসের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, আবার কোথাও সময়ের অসামঞ্জস্য শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়ায়। শিক্ষার্থীদের জীবন ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বোঝা যায় লাল বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আবার কতটা জটিল।
একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, ‘ভর্তি হওয়ার দিন থেকেই আমার একটাই ইচ্ছা ছিল, কবে লাল বাসে উঠব। প্রথম দিন বাসে ওঠার সময় মনে হয়েছিল আমি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে গেছি।’
অন্যদিকে এক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীর কণ্ঠে শোনা গেল আক্ষেপ। তিনি বলেন, ‘আর কদিন পর হয়তো লাল বাসে ওঠা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চার বছর ধরে যত স্মৃতি জমেছে, তার অর্ধেকই এই বাসে। বন্ধুদের সঙ্গে সকালবেলার যাত্রা, গান, তর্ক-বিতর্ক সব মনে পড়বে।’
লাল বাসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে লাল বাস এখন এক প্রতীকী অবস্থান তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচিত হন তাদের পড়াশোনা দিয়ে, কিন্তু অনেক সময় তাদের পরিচয়ের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায় লাল বাস।
অন্যদিকে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা চাকরিজীবনে বা প্রবাসে থেকেও লাল বাসের স্মৃতিকে মনে রাখেন। আড্ডায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই তারা স্মৃতিচারণ করেন, ‘নিজ ক্যাম্পাসের এসব বাস দেখলেই বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, নিয়মিত এসব বাসে করে যাতায়াত করতাম। বন্ধুদের সাথে আড্ডা-খুনসুটি করে কখন সময় চলে যেত, বুঝতামই না।’
এছাড়া লাল বাস নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা গান, গল্প, এমনকি ক্যাম্পাস সংস্কৃতির আড্ডায় এটি জায়গা করে নিয়েছে। রাজনৈতিক আলোচনা থেকে প্রেমের গল্প- সব কিছুতেই লাল বাসের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস কোনো সাধারণ যানবাহন নয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রতীক, শিক্ষার্থীদের স্মৃতি, আনন্দ ও হতাশার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভর্তির দিন থেকে শুরু করে স্নাতক সমাপ্তি পর্যন্ত হাজারো গল্প জড়িয়ে থাকে এই বাসের সঙ্গে।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য লাল বাস এক জীবন্ত স্মারক, যা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতোই একদিন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু থেকে যায় হৃদয়ের গভীরে।
এএইচ

