ঢাকার বুকে কংক্রিটের ভিড়ে আটকে থাকা মানুষের কাছে ধানমন্ডি লেক এক টুকরো মুক্তির নাম। শতবর্ষী গাছের ছায়া, লেকের শান্ত পানি আর চারপাশের জমজমাট জীবনযাত্রা সব মিলিয়ে এই লেক যেন রাজধানীর একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কোলাহলপূর্ণ শহরের মাঝে এই লেক যেন এক টুকরো শান্তি, বিনোদন আর বৈচিত্র্যময় জীবনের মিলনমেলা। সকালবেলা হেঁটে যাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে দুপুরে প্রেমিক-প্রেমিকা, সন্ধ্যায় পরিবার কিংবা রাতের খানিকটা নিরিবিলি সময় কাটাতে আসা শহুরে মানুষ—সবাইকে একসাথে দেখা যায় এখানে।
ধানমন্ডি লেক কেবল বিনোদনের জায়গা নয়; এখানে জীবন সংগ্রামের গল্প আছে। খুদে হকারদের খেলনা বিক্রি, ভেলপুরি-ফুচকা-চটপটির দোকান আর স্থানীয় শিল্পীদের গান—সব মিলিয়ে লেক একরকম ছোট সমাজের প্রতিচ্ছবি।
বিজ্ঞাপন

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অস্তিত্ব
ধানমন্ডি লেকের জন্ম ঘটেছিল মূলত ‘ক্যারাভান (বর্তমানে কাওরান) বাজার নদী’র পতিত খালের অবশিষ্ট অংশ থেকে, যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে শহরমুখী পরিবর্তনের ফলে লেকে পরিণত হয়। মহল্লা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৬০-এর দশকে এটি কৃত্রিমভাবে খনন ও গভীর করা হয়, যেখানে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা স্থাপনের সময় ১৬% জমি লেকের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
১৯৯৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিস্তৃত সংস্কার কাজ শুরু হয়। এতে হাঁটার পথ, গাছপালা, সেতু, লণ্ঠন, প্রদর্শনী মঞ্চ (রবীন্দ্র সরোবর) এবং সুবিধাসমূহ তৈরি করা হয়, যা ২০০০ সালে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রায় ৩ কিলোমিটার লম্বা, ৩৭.৩৭ হেক্টর আয়তনের এই লেকের প্রস্থ ৩৫–১০০ মিটার ও গভীরতা সর্বোচ্চ ৪.৭৭ মিটার। এটি উত্তরে মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া, পশ্চিমে সাতমসজিদ রোড, দক্ষিণে বিএসআর গেট ও পূর্বে কালাবাগান এলাকায় সীমাবদ্ধ। একমাত্র চৌকাঠ (বক্স কালভার্ট) ব্যবহার করে অতিরিক্ত বর্ষাজল বের করা হয়, যা লেকের পানির স্তর সমান্তরাল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে রাত অবধি লেকের চারপাশে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। সকালে এখানে এসে হাঁটে বয়স্ক মানুষজন, ব্যায়াম করে তরুণরা। বিকেলের দিকে লেক রূপ নেয় আড্ডার আঙিনায়। বন্ধুদের আড্ডা, প্রেমিকযুগলের সময় কাটানো কিংবা পরিবার নিয়ে হালকা বিনোদনের জায়গা—সবই মিলে ধানমন্ডি লেককে করেছে রাজধানীবাসীর প্রাণকেন্দ্র।
একজন নিয়মিত ভিজিটর, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. কামাল উদ্দিন বললেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে এখানে হাঁটতে আসি। এই লেক না থাকলে হয়তো শরীর এবং মনকে এতটা ভালো রাখা সম্ভব হতো না।’

রবীন্দ্র সরোবর: সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র
ধানমন্ডি লেকের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ হলো রবীন্দ্র সরোবর। লেকের পাড় ঘেঁষে নির্মিত এই উন্মুক্ত মঞ্চটি শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, বরং রাজধানীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও প্রাণকেন্দ্র। প্রায় প্রতিদিনই এখানে ছোট-বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পহেলা বৈশাখ, দুই ঈদে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শক আসে। তরুণ শিল্পীরা গান, আবৃত্তি, নাটক পরিবেশন করে। আবার নানা সামাজিক ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানও হয় এই মঞ্চ ঘিরে। বলা যায়, রবীন্দ্র সরোবর ঢাকার মানুষের কাছে শুধু লেকের সৌন্দর্যের অংশ নয়, বরং সংস্কৃতিচর্চারও একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

খুদে হকারদের সংগ্রাম, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য
ঢাকার দিনে শহুরে আবেশ থেকে কিছু সময়ের অবকাশ হিসেবে ধানমন্ডি লেক হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। সকালের সূর্যোদয়ে তাজা বাতাস, হেলায় হেলায় হাঁটা, ধীর জগিং, যোগা ও মেডিটেশনের ক্লাব—সবই রবীন্দ্র সরোবরের পরিবেশে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেক সময়ে এখানে স্বাস্থ্যপরিমাপের জন্য খুদে হকাররা আসেন; রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওজন ও রক্তচাপ মাপেন, যা তাজা ভোরের উদ্যমে দাঁড়ানোর জন্য আগ্রহ তৈরি করে।
ধানমন্ডি লেক স্থানীয় অর্থনীতিরও বড় অংশ। এখানে ফুচকা, ভেলপুরি, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম বিক্রেতাদের দৈনিক আয়ে অনেক পরিবার চলে। শুধু তাই নয়, লেকের চারপাশে রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেগুলোও ভিড়ে জমজমাট থাকে।

রেস্তোরাঁ মালিক সাব্বির হোসেন বলেন, “লেকের কারণে আমাদের ব্যবসা ভালো চলে। সন্ধ্যায় লেকে যারা ঘুরতে আসে, তাদের অনেকেই পরে আমাদের রেস্তোরাঁয় খেতে যায়।”
ধানমন্ডি লেক শুধু এখনকার নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি সম্পদ। কিন্তু এটিকে বাঁচিয়ে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। দখল, দূষণ, অব্যবস্থাপনা—এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে লেক ঢাকার মানুষের জন্য আরও উপকারী হয়ে উঠতে পারে।
পার্কে ঘুরতে আসা ফারজানা রহমান বলেন, ‘ধানমন্ডি লেক কেবল বিনোদনের জায়গা নয়, এটা ঢাকার একটি ইকোসিস্টেম। যদি আমরা এখনই এর সুরক্ষা নিশ্চিত না করি, তবে একদিন হয়তো এটা হারিয়ে যাবে।’

পরিবেশগত দিক
এই লেকের সৌন্দর্য আজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। দূষণ ও আবর্জনার কারণে পানির মান দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন এখানে প্রতিদিন ফেলা হয়, যা লেকের পরিবেশের জন্য হুমকি। পরিবেশবিদদের মতে, যদি সঠিক উদ্যোগ নেওয়া না হয় তবে অচিরেই লেকটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাবে।
একজন শিক্ষকের মতে, ‘শহরে লেকগুলো প্রাকৃতিক ফুসফুসের মতো কাজ করে। ধানমন্ডি লেক যদি আমরা বাঁচাতে না পারি, তাহলে শহরের পরিবেশ আরও খারাপ হবে।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ইয়ুঙ্গর (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) কন্টাক্ট পয়েন্ট জেসমিমা সাবাতিনা বলেন, ‘ধানমন্ডি লেক শুধু একটি জলাধার নয়, এটি নগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-পরিবেশগত ব্যবস্থা। লেক নগরবাসীকে নানা ধরনের ইকোসিস্টেম সার্ভিস দিচ্ছে যেমন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বৃষ্টির পানি ধারণ, কার্বন শোষণ ও বায়ুর মান উন্নয়ন। একইসঙ্গে এটি শহরের পাখি, মাছ ও উদ্ভিদের জন্য জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল।
তবে প্লাস্টিক দূষণ, অপরিকল্পিত বাণিজ্য, শব্দ-আলোক দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর ভারসাম্য নষ্ট করছে। পাশাপাশি লেকে খুদে হকারদের জীবিকা, তরুণদের বিনোদন ও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। তাই ধানমন্ডি লেক সংরক্ষণে সমন্বিত নীতি জরুরি, যেখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, টেকসই জীবিকা ও নাগরিকদের জন্য নিরাপদ স্থান নিশ্চিত করতে হবে।’

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধানমন্ডি লেককে টেকসই রাখতে হলে নাগরিকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং পানির শোধন চালু রাখা জরুরি। সেইসঙ্গে খুদে হকারদের জীবিকা সুরক্ষায় একটি সুশৃঙ্খল নীতি দরকার, যাতে লেকের পরিবেশও নষ্ট না হয় আবার জীবিকার সুযোগও হারিয়ে না যায়।
ধানমন্ডি লেক ঢাকার হৃদয়ে এক অনন্য জায়গা। এখানে যেমন বিনোদন আর বিশ্রামের সুযোগ আছে, তেমনি আছে সংগ্রামী মানুষের জীবনকথা। সবকিছু মিলিয়ে ধানমন্ডি লেক একটি জীবন্ত সমাজ। এখন প্রয়োজন এই লেককে আরও নিরাপদ, পরিষ্কার ও সবার জন্য উপভোগ্য করে তোলা। তাহলেই ধানমন্ডি লেক ঢাকার মানুষের হৃদয়ে আরও গভীরভাবে জায়গা করে নেবে।
ধানমন্ডি লেক শুধু ঢাকার একটি জলাধার নয়; এটি একটি জেগে ওঠা শহুরে গল্প, যেখানে অতীতের নদী থেকে বর্তমানের জীবন অতিক্রম করে। এখানে খুদে হকারদের মোহনায় নিহিত হয় শহরের সংস্কৃতি ও দরিদ্রতা নিয়ে টিকে থাকা জীবনের সংমিশ্রণ। তবে পরিবেশ ও প্রশাসনিক মনোযোগ না দিলে ভবিষ্যৎ ততটা সুখকর নাও হতে পারে।
এআর

