ঢাকার ব্যস্ততম এলাকায় অবস্থিত মহাখালী ফ্লাইওভার ভ্রমণকারী এবং পথ-চলতি মানুষের জন্য ক্লান্তিকর ও রূপহীন পরিবেশের প্রতীক ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ২০২৩ সালে এই ফ্লাইওভারের পিলারে ও নিচের অংশে চিত্রকর্ম বা স্ট্রিট আর্ট আঁকানোর সৃজনশীল উদ্যোগ নেয়। যা নগরীর সৌন্দর্য বাড়ায় এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। এখন মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে ঢুকলেই বদলে যায় সেই ধূসর অনুভূতি। চোখে পড়ে রঙের মেলা, নান্দনিক চিত্রকলা, গ্রামীণ জীবনের মোটিফ এবং সামাজিক বার্তা।
ঢাকার ব্যস্ততম মহাখালী ফ্লাইওভার যেটি দীর্ঘ সময় কংক্রিটের ধূসর রঙে আচ্ছাদিত ছিল তা এখন রঙিন চিত্রকর্মে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। নানা সাংস্কৃতিক মোটিফ, প্রকৃতি ও সচেতনতার বার্তা মিশে এই ফ্লাইওভার এখন শুধু যানবাহনের চলাচলের অবকাঠামো নয়, হয়ে উঠেছে এক খোলা ক্যানভাস।
বিজ্ঞাপন
বার্জার পেইন্টসের করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসার) কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ ধরনের উদ্যোগ শুধু সৌন্দর্য বর্ধন নয়, নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির এক অভিনব মাধ্যম।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ যৌথভাবে এই উদ্যোগ নিয়ে ‘রঙ বদলে রঙিন করি’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি মূলত নগরীর সৌন্দর্য বর্ধন, নাগরিক সচেতনতা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শুরু করে এবং ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রকল্পটির শেষ হয়। প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন ঢাকার সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিন মাসের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়, ফলে বদলে যায় মহাখালী ফ্লাইওভারের চেহারা।
দেশের তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীরা এ প্রকল্পে অংশ নেন। তারা দেশের লোকশিল্প ও আল্পনার উপাদান ব্যবহার করে আঁকেন নানা রঙিন চিত্র, বাংলাদেশী উৎসব, ঐতিহ্য, যেমন: পুতুল, বাউল, জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, রিকশা, নৌকা, টেপা পুতুল, হাতপাখা, গরুর গাড়ি ইত্যাদি। জাতীয় ইতিহাস ও সংগ্রাম, যেমন: ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর তর্জনী, ‘বাঁচলে দেশ আমরা বাঁচব’, ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ’ প্রভৃতি। সচেতনতামূলক বার্তা (অ্যাওয়ারনেস স্লোগান): ‘গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও’, ‘হর্ন বাজানো নিষেধ’ ইত্যাদি।
বিজ্ঞাপন

টেপা পুতুল গ্রামীণ জীবনের প্রতীক, রঙিন পাখি ও পশু প্রকৃতি ও সহাবস্থানের প্রতিফলন, রিকশা ও বাসের মোটিফ ঢাকার নগরজীবনের প্রতিচ্ছবি, সচেতনতামূলক স্লোগান – যেমন ‘গাছ বাঁচাও জীবন বাঁচাও’, ‘হর্ন বাজানো নিষেধ।’
শিল্পীরা এটিকে বর্ণনা করেছেন এক ‘উৎসবের ছাতা’ হিসেবে, যেখানে পথচারীরা হাঁটলেই রঙের জগতে প্রবেশ করেন।
সেলিম নামে একজন রিকচালক বলেন, ‘আগে এখানে নামলেই বিরক্তি লাগত। এখন মনে হয় আনন্দমেলা চলছে। রঙিন দেওয়াল দেখে ভালো লাগে। গাড়ি চালাতে এখন আর একঘেয়েমি লাগে না। এটা শুধু রঙ নয়, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি।’
শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মহাখালী ফ্লাইওভারের দেয়ালচিত্র প্রমাণ করেছে যে, রঙ ও শিল্প নগরীর চেহারা বদলে দিতে পারে। মেট্রো রেলের সড়ক ও স্টেশনগুলোতেও যদি একইভাবে শিল্পকর্ম করা হয়, তবে যাত্রীরা প্রতিদিন নান্দনিক পরিবেশ পাবেন। এতে জনসাধারণের মানসিক স্বস্তি বাড়বে এবং নগর পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। ঢাকা তখন সত্যিই আধুনিক ও সংস্কৃতিমণ্ডিত শহর হিসেবে পরিচিত হতে পারবে। এই পরিবর্তন শুধু রঙের নয়, এটি নগরবাসীর মানসিক প্রশান্তিরও প্রতীক।’
নগরবাসী বলছেন, এই শিল্পকর্ম শুধু চোখের আরাম নয় বরং সমাজের জন্যও বহন করছে বার্তা। যেমন: পরিবেশ সচেতনতা হিসেবে গাছ বাঁচানোর আহ্বান, শব্দ দূষণ কমানোর লক্ষ্যে হর্ন বাজানো নিষেধ, দেশপ্রেম জাগ্রত করতে ‘দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচবো বেশ’।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ঘোষণা দিয়েছিল এখানে কোনো পোস্টার লাগানো যাবে না। নিয়ম ভাঙলে নেওয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থা। এছাড়া শিল্পকর্ম রক্ষায় বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরাও।
বিশ্বের বড় শহরগুলোতে রাস্তার দেয়ালচিত্র পর্যটন ও সংস্কৃতির অংশ। বার্সেলোনা, নিউ ইয়র্ক কিংবা প্যারিসে যেমন দেখা যায়, ঢাকাও এখন সেই পথেই হাঁটছে। মহাখালী ফ্লাইওভার হয়ে উঠেছে এক দৃষ্টান্ত যা ভবিষ্যতে অন্যান্য ফ্লাইওভার বা সড়কেও অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
মহাখালী ফ্লাইওভারের রঙিন রূপ শুধু একটি শিল্পপ্রয়াস নয়, এটি নগরবাসীর মানসিক প্রশান্তি, সামাজিক সচেতনতা ও নগর সৌন্দর্যের প্রতীক। ডিএনসিসি ও বার্জার পেইন্টসের এই যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় আরও বাসযোগ্য, সুন্দর এবং আনন্দময় শিল্পকর্ম চায় নগরবাসী।
একঘেয়ে কংক্রিটের দেয়ালের ভিড়ে এই রঙিন চিত্রগুলো মনে করিয়ে দেয় শহর শুধু ধুলো, ধোঁয়া ও যানজট নয়; শহর হলো রঙ, সংস্কৃতি আর মানুষের মিলনমেলা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বুয়েটের শিক্ষক হাদিউজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি বা মন মানসিকতায় এখনো বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। কোনো নতুন অবকাঠামো তৈরি হলেই আমরা তার দেয়াল বা খালি জায়গায় রাজনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক পোস্টার সেঁটে দিই। অথচ ঢাকার সৌন্দর্য আগেই মাথার ওপর তারের জঞ্জালে নষ্ট হয়ে গেছে। এর সঙ্গে পোস্টার যুক্ত হলে নগরের নান্দনিকতা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘চালক বা পথচারী যখন প্রসারিত সড়কে দেয়ালচিত্র বা রঙিন গ্রাফিতি দেখতে পান, তখন তাদের মানসিকতায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ গ্রাফিতিতে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফুল-ফল কিংবা পশু-পাখির মতো দৃশ্য অঙ্কিত থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব গ্রাফিতির ওপরও পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়, যা শহরের সৌন্দর্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘আমরা সবসময় সড়কের ইকো-সিস্টেম নিয়ে কথা বলি। ফ্লাইওভারও তার অংশ। সেখানে যখন শুধু বিজ্ঞাপন ঝুলতে থাকে, তখন চালক ও পথচারীর মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। অথচ এখন অনলাইনের যুগ এই ব্যানার-ফেস্টুনের পরিবর্তে যদি ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ব্যবহৃত হয়, তাহলে শহরের সৌন্দর্য যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি বিজ্ঞাপনও কার্যকর হবে।’
বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, ‘২০১২ সালে একটি আইন হয়েছে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোথায় গ্রাফিতি করা যাবে আর কোথায় পোস্টার, ব্যানার বা ফেস্টুন সাঁটানো যাবে। এখন সেই আইনকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা প্রায়ই শুনি তারা বলে এত বড় শহরে সব জায়গা মনিটরিং করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। কিন্তু এই ধরনের অজুহাত দিয়ে সিটি করপোরেশনের পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’
তার মতে, ‘কারণ সড়ক এবং সড়ক-সংলগ্ন অবকাঠামোর দায়িত্ব যেহেতু সিটি করপোরেশনের, তাই মনিটরিং করা তাদের অবশ্যই করতে হবে। আর যারা এ ধরনের কাজে জড়িত, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিকদেরও খেয়াল রাখতে হবে, যেন তাদের পোস্টার যত্রতত্র না সাঁটানো হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে শুধু মহাখালী ফ্লাইওভার নই পুরো শহরের সৌন্দর্য রক্ষা করা সম্ভব।’
এম/জেবি

