পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত হাজারীবাগ পার্ক। নাম শুনলেই মনে হয় পুরান ঢাকার ভেতর একটি সতেজ সবুজ জায়গা, যেখানে নাগরিকরা ভিড়ভাট্টার জীবন থেকে কিছুটা শান্তি খুঁজে পাবেন। কিন্তু বাস্তবে এ পার্কের অবস্থা একেবারেই ভিন্ন। এখানে নেই সবুজ ঘাস, নেই তেমন একটা ছায়াদানকারী গাছ, নেই শীতল বাতাস। কংক্রিট, শুকনো মাটি আর ধুলো মিলে পরিবেশ এমন যে, প্রচণ্ড গরমে এখানে অবস্থান করা কষ্টকর।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে প্রতিজন নাগরিকের জন্য সবুজ জায়গার পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কয়েক গুণ কম। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) প্রতি নাগরিকের জন্য অন্তত ৯ বর্গমিটার সবুজ জায়গা সুপারিশ করেছে, সেখানে ঢাকায় তা মাত্র ১.৫ বর্গমিটার। এ অবস্থায় প্রতিটি পার্কই শহরবাসীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হাজারীবাগ পার্ক সেই গুরুত্ব কোনোভাবেই পূরণ করতে পারছে না।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা এই পার্কটি কখন তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে স্থানীয়রা বলছেন, অন্তত তিন দশক ধরে এটি এলাকার একমাত্র খোলা জায়গা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে, ঘাসও রোপণ করা হয়নি। এখন পুরো জায়গাটি রোদে পুড়ে নির্জীব পড়ে আছে।
ঢাকার সবুজ সংকট ও হাজারীবাগ পার্ক
ভোর ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে পার্কে কিছু মানুষ হাঁটতে আসেন। কেউ স্বাস্থ্যচর্চা করেন, কেউ আবার একসঙ্গে বসে আড্ডা দেন।
বিজ্ঞাপন

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সকালে একটু হাঁটতে আসি। কিন্তু চারদিকে শুধু খালি মাটি আর কংক্রিট গরম খুব দ্রুত ধরে যায়। আমাদের বয়সীদের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। শিশুদের নিয়ে আসতে চাই, কিন্তু এখানে রোদ ছাড়া কিছু নেই। বাচ্চারা খেলতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। সকালে আসা মানুষরা সবাই অল্প সময়েই চলে যান।’
বিকেল ৪টা থেকে পার্কে জড়ো হয় শিশু ও কিশোররা। তারা ক্রিকেট, ফুটবল বা দৌড়ঝাঁপ করে সময় কাটায়। কিন্তু খেলতে গিয়ে তাদের অসুবিধা হয় ধুলো আর তীব্র গরমে।
কলেজ শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিকেলে ফুটবল খেলতে আসি। কিন্তু ঘাস নেই, শুধু মাটি। দৌড়ানোর সময় ধুলো উড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে চোটও লাগে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসি। কিন্তু ছায়া নেই বলে বসে থাকা যায় না।’
রাতে পার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত লাইটিং নেই, ফলে অন্ধকারে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে স্থানীয়রা রাতে এ পার্কে যেতে চান না।
বেসরকারি চাকরিজীবী শাহীন আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাতে হাঁটতে বা বসতে ইচ্ছে করে না। ভয় লাগে, নিরাপত্তা নেই। যদি আরও লাইটিং আর গাছপালা থাকত, তবে পরিবেশটা অন্যরকম হতো।’
ঢাকার অন্যান্য বড় পার্ক যেমন রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা হাতিরঝিল-এগুলোতে গাছপালা ও ঘাস থাকায় মানুষ স্বস্তি পান। হাজারীবাগ পার্কে সেসব নেই বলে স্থানীয়রা হতাশ। তারা চান পরিকল্পিতভাবে যেন গাছ লাগানো হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, হাজারীবাগ পার্ককে সত্যিকার অর্থে প্রাণবন্ত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন গাছ লাগানো ও সবুজ ঘাস রোপণ। তাদের মতে, পার্ক মানেই ছায়া, ঠান্ডা আর সবুজের সমারোহ-কিন্তু এখানে তার কোনো ছাপ নেই। চারদিকে কেবল খালি মাটি আর ধুলো। যদি বড় বড় গাছ রোপণ করা হয় আর মাঠজুড়ে ঘাসের কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীণরা পর্যন্ত স্বস্তি পাবে।
এছাড়া তারা চান পর্যাপ্ত বেঞ্চ ও বসার ব্যবস্থা। বর্তমানে পার্কে বসার মতো জায়গা নেই বললেই চলে। যে কয়েকটি রয়েছে, সেগুলোও অপ্রতুল ও ভাঙাচোরা। ফলে পরিবার নিয়ে বা বৃদ্ধরা এসে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারেন না।
পার্কে আসা মানুষদের আরেকটি জোরালো দাবি হলো লাইটিং উন্নতকরণ। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে পার্ক কার্যত পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আলোর অভাবের কারণে নিরাপত্তাহীনতার ভয়ও থাকে। পর্যাপ্ত বাতি বসানো হলে মানুষ নিশ্চিন্তে রাতেও হাঁটাহাঁটি বা আড্ডা দিতে পারবে।
স্থানীয়রা বলছেন, শিশুদের জন্য আলাদা খেলার সরঞ্জাম থাকা জরুরি। বর্তমানে শিশুদের জন্য কোনো দোলনা, স্লাইড বা নিরাপদ খেলার উপকরণ নেই। কেবল ধুলোয় ভরা মাঠে তাদের খেলতে হয়। খেলাধুলার এই অভাব শিশুদের আকর্ষণ করে না, বরং তাদের ঝুঁকিতে ফেলে।
তাদের মতে, এসব পরিবর্তন একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা গেলে হাজারীবাগ পার্ক আবারও হয়ে উঠতে পারে পুরনো ঢাকার মানুষের প্রিয় মিলনকেন্দ্র ও বিশ্রামের আস্তানা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি গত মাসের ১৮ তারিখে জয়েন করেছি। আমি পার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। দুই একদিনের মধ্যেই পার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নেব এবং সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করব।’
এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে একাধিক বার মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিলুর রহমান খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাষ্ট্র অনেক পার্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের নাম দিয়ে প্রচুর কংক্রিট ব্যবহার করে এগুলোকে নষ্ট করছে। আসল পার্ক মানে হচ্ছে সবুজ গাছপালা, পার্কে অল্প কিছু ওয়াকওয়ে থাকলেই তা ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে। সহজভাবে একটা পার্কের উন্নয়ন করা সম্ভব।’
তার মতে, ‘হাজারীবাগ পার্কে দ্রুত সময়ে কম খরচে কীভাবে সবুজায়ন বাড়ানো যায় এবং ল্যান্ডস্কেপিং উন্নত করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমাদের করপোরেশনের ট্যাক্সের টাকা মানুষদের নিঃশ্বাস ফেলায় ব্যবহৃত স্থানগুলোর জন্য ব্যয় হওয়া উচিত, যাতে তা ব্যবহারযোগ্য থাকে।’

আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘যে শহরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হয়, সেখানে সদিচ্ছা, কার্যকর ও ব্যয় সাশ্রয়ী সবুজ-নির্ভর পরিকল্পনা থাকলে এই পার্কগুলোকে পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব। এছাড়া কমিউনিটি বা স্থানীয় কমিটিকে সংযুক্ত করলে ভবিষ্যতে পার্কগুলোর যথাযথ দেখভাল নিশ্চিত করা সম্ভব।’
বিশ্লেষকদের মতে, হাজারীবাগ পার্কের বর্তমান অবস্থা কিছুটা হতাশাজনক। পার্কটিতে গাছের সংখ্যা হাতে গোনা, সবুজ ঘাস প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে মানুষ এখানে এলে প্রকৃতির স্বস্তি, ছায়া কিংবা সজীবতার অভিজ্ঞতা পায় না। একটি পার্ক শুধু বিনোদনের স্থান নয়, বরং এটি নগরবাসীর মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পার্কে আরও গাছ লাগানো, ছায়াযুক্ত বসার স্থান তৈরি এবং পানি-ফোয়ারা স্থাপনের পরামর্শ দেন তারা।
হাজারীবাগ পার্ক একদিকে এলাকার একমাত্র খোলা জায়গা, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার প্রতিচ্ছবি। সারাদিনই মানুষ এখানে আসে, কিন্তু গাছপালা ও ঘাসের অভাবে তাদের অভিজ্ঞতা নেতিবাচক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরবাসীর জন্য এই পার্ককে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই বড় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এম/জেবি

