মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভ্যাট-শুল্ক বাড়িয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না গাড়ি বিলাস!

মাহফুজুর রহমান
প্রকাশিত: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

car
রাজধানীতে পুরনো গাড়ির মার্কেট। ছবি: ঢাকা মেইল

জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ রাজধানী ঢাকায় আসছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসার প্রয়োজনে এই শহরে নতুন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিবারের সংখ্যা। সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে যাতায়াতের চাহিদা। কিন্তু বাড়তি যাত্রী সামাল দিতে পারছে না রাজধানীর গণপরিবহনব্যবস্থা। অপ্রতুল ও অনিয়মিত গণপরিবহনের কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এই অবস্থায় বিকল্প সমাধান হিসেবে অনেকেই ঝুঁকছেন ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে। ফলে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এতে সড়কের সক্ষমতা না বাড়ায় ঢাকায় যানজট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গড়ে গাড়ির গতি নেমে এসেছে মাত্র ৪.৮ কিমি প্রতি ঘণ্টায়, যা নগরবাসীর সময় ও অর্থ দুইই নষ্ট করছে। তবু যান্ত্রিক নগরীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গাড়ি। উচ্চ শুল্ক-ভ্যাটের দ্বারা সরকার ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা নিরুৎসাহিত করছে। তবে এরপরও থামছে না গাড়ি বিলাশ। শুল্ক-ভ্যাটের কারণে অনেকে নতুন গাড়ির পরিবর্তে পুরনো গাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে ‘পুরাতন গাড়ির হাট’ হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় বিকল্প।

দেশে গাড়িতে ভ্যাট কত?

গাড়ির ক্ষেত্রে মোট মূল্য নির্ধারণের সময় কাস্টমস ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি (এসডি), এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি), রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) এবং এডভান্স ট্রেড ভ্যাট (এটিভি)-সহ সব ধরনের শুল্ক-কর যোগ করা হয়। এরপর সেই পরিমাণের ওপর ১৫% ভ্যাট ধার্য করা হয়।

Car2


বিজ্ঞাপন


৩০,০০,০০০ টাকার নতুন গাড়িতে ভ্যাট হিসাবে, ১৫% × ৩০,০০,০০০ = ৪,৫০,০০০ টাকা হবে। তবে এতে এসডি যুক্ত হলে করের পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: ১৫০০ সিসি বা তার বেশি গাড়িতে এসডি নিয়মে পৃথকভাবে কর ধার্য করা হয়; ২০০০ সিসির উপরে গাড়িতে ২০০% থেকে ৩০০% পর্যন্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে, ৩০ লাখের গাড়িতে (এসডি) যদি ২০০% হয়, তাহলে SD হবে ৬০,০০,০০০ টাকা, যা মূলের দ্বিগুণ। সাধারণত ছোট গাড়ির মোট শুল্ক-কর পরিমাণ হয় প্রায় ১২৮% (সিআইএফ-এর), আর বিলাসবহুল বা ৪০০০ সিসির ওপরে গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর+কর মোট পরিমাণ ৮০০% অতিক্রম করতে পারে।

আরও পড়ুন

মেট্রো স্টেশনের ফুটপাত গিলে খাচ্ছে হকার, বিড়ম্বনায় যাত্রীরা

কারা ভ্যাট সুবিধা পায়? কেন পায়?

দেশে বর্তমানে গাড়িতে কোনো সাধারণ ‘ভ্যাট ছাড়’ বা অব্যাহতি নেই। তবে বিভিন্ন প্রণোদনা-নীতির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের (যেমন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বা এমপিরা) কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় বা শর্তসাপেক্ষ সুবিধা থাকতে পারেন, যা আইন অনুযায়ী নির্ধারিত। এগুলো সাধারণ জনগণের জন্য নয়, বরং নির্দিষ্ট অধিকারবলে বিবেচিত হয়। বিস্তারিত তথ্যাদি সরকার বা সংশ্লিষ্ট সরকারি আদেশে থাকতে পারে, তবে সাধারণ ক্রেতাদের ক্ষেত্রে ভ্যাট অতিরিক্ত ছাড় প্রযোজ্য নয়। সাধারণ নীতি অনুসারে, সরকারি গোপন সিদ্ধান্ত যেমন রাষ্ট্রীয় গাড়ি, নিরাপত্তা বা মিশনসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে ভ্যাট বা আমদানি শুল্কে ছাড় দেওয়া হতে পারে। স্বরাষ্ট্রীয় সুবিধার আওতায় কিছু নির্দিষ্ট সরকারি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর ছাড় প্রযোজ্য হতে পারে, তবে এটি স্পষ্ট নয় যে, কোন আইন বা আদেশ অনুযায়ী এটা হতে পারে।

পুরনো গাড়ির হাটে যেভাবে বিক্রি হয়

ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রতি সপ্তাহে 'কার হাট' বসে। প্রতি শুক্রবার সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত গাড়ি প্রদর্শনী ও বিক্রয় চলে আসছে প্রায় ২৫ বছর ধরে। প্রায় ১২০টি গাড়ি এখানে সাজানো থাকে, বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও অবস্থা (পুরাতন থেকে নতুন)-প্রতিটি গাড়ির সামনে রয়েছে লিফলেট, যাতে গাড়ির নাম, মডেল, দাম, ইঞ্জিন নম্বর ইত্যাদি তথ্য থাকে। প্রয়োজনে ক্রেতা গাড়ির দরজা খুলে ভেতর ও ইঞ্জিন দেখতে পারেন, বিক্রেতারা তথ্য জানাতে প্রস্তুত থাকে। ‘কার হাট’ আয়োজনকারী সংস্থা গাড়ির কাগজপত্র, মালিকানা ও সম্ভাব্য মামলা-মামলার বিষয়ে নিশ্চিত করে, যাতে ক্রেতা নিরাপদে গাড়ি কিনতে পারেন। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যস্থতা, দরকষাকষি ও ৫% অগ্রিম প্রদানসহ পরে কাগজপত্র হস্তান্তরের সুযোগ রয়েছে। ‘কার হাট’ ১৯৯৯ সালে শুরু হয়, এরপর থেকে এটি ঢাকা শহরের অন্যতম পরিচিত ও বিশ্বস্ত ব্যবহৃত গাড়ি মার্কেটপ্লেসে পরিণত হয়েছে।

Car3

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)’র সদস্য আব্দুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে রিকন্ডিশন্ড বা পুরাতন গাড়ির বাজারে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। যাদের সহজে অর্থ উপার্জনের পথ ছিল, যাদের হাতে নগদ টাকা ছিল-তাদের অনেকেই এখন পলাতক কিংবা নিজেদের অর্থ লুকিয়ে রেখেছে। অনেকে আবার টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ফলে গাড়ির বাজারও স্থবির হয়ে আছে।’

আরও পড়ুন

নামেই পার্ক, বাস্তবে কংক্রিটের মাঠ

আব্দুল হক বলেন, ‘নতুন এক শ্রেণি অর্থশালী তৈরি হলে বাজারের মন্দাভাব কাটতে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে নানা ধরনের কার্যক্রম বাড়ে, টেন্ডার বেড়ে যায়। তখন আয় বাড়ে আর গাড়ির বাজারও চাঙ্গা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস এটাই বলে।’

বিগত বছরের তুলনায় বাজার ও ভ্যাটে পরিবর্তন

বর্তমান ভ্যাট হার (২০২৫ সাল অনুযায়ী) সাধারণভাবে ১৫%-ই থাকছে। গাড়িতে এসডি হার কিছু ক্ষেত্রে আরও বাড়ানো হয়েছে; বাজেটে পরিবেশগত শুল্ক ইলেকট্রিক যানবাহনে সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব রয়েছে। পুরনো গাড়ির বাজার বর্তমানে ইউএসডি ১.৫৪ বিলিয়ন (২০২৫) এবং ২০২৪-৩০ পর্যন্ত সিএজিআর ৭.১%। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও সংগঠিত ব্যবসায়ী বাড়ছে। ঢাকায় সারাদেশের প্রায় ৫৪% লেনদেন হয়। ৩-৫ বছরের গাড়ির চাহিদা বাড়ছে।

Car4

গাড়ি কিনতে আসা ফরিদ উদ্দিন সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘৩০ লাখ টাকা বাজেট নিয়ে এখানে এসেছি। ভ্যাট মাত্র ১৫% শুনে ভালো লাগল, প্রায় ৪.৫ লাখ টাকা হবে, যার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তবে যারা বড় ইঞ্জিনের গাড়ি নেয়, ওজনের এসডি-এর কারণে ভারটি অনেক বাড়তে পারে। এখানে কিছু বিক্রেতা এমন গাড়ি নিয়ে আসে যা ৩-৫ বছর পুরানো, দাম কিছুটা কম, আর অনলাইন বা হাটের মাধ্যমে আকর্ষণীয় অফার পাওয়া যায়, যার ফলে বড় সংখ্যা ক্রেতা এখানে আসে।’

আরও পড়ুন

রিকশা: প্যাডেল থেকে ব্যাটারি, নগরীর স্বস্তি নাকি সড়কের বিপদ?

নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদিলুর রহমান খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একটি আদর্শ নগরে যে পরিমাণ রাস্তা থাকার কথা ঢাকায় সে পরিমাণ রাস্তা নেই। একটি আদর্শ নগরে ২০-২৫ শতাংশ ভূমি সড়কের জন্য বরাদ্দ থাকলেও, ঢাকায় সেটার পরিমাণ নেমে দাঁড়িয়েছে ৭-৮ শতাংশে। এমনিতেই রাস্তার জন্য স্বাভাবিক জায়গা নেই, তার মধ্যে যে পরিমাণ গাড়ি দিনে দিনে বাড়ছে; বিশেষ করে আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা, নতুন করে অটোরিকশা এবং ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল। আমাদের দেশে গাড়ির সংখ্যা লিমিটের কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বা অবকাঠামো অনুযায়ী গাড়ির সংখ্যা লিমিট করে দেওয়া থাকে। এমনিতেই আমাদের সড়ক অবকাঠামো আদর্শ নগরের তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে আবার অবৈধ পাকিং এবং হকারদের কারণে যে রাস্তার বৃহৎ অংশ দখল হয়ে থাকে।’

Car5

এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘উচ্চ ভ্যাট এবং শুল্ক আরোপের ফলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তা পুরোপুরি কার্যকর পদপক্ষেপ নয়। যাদের গাড়ি কেনার প্রয়োজন আছে তারা ভ্যাটের চিন্তা করে না। ঢাকায় যেহেতু ভালো গণপরিবহন নেই সেহেতু উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তারা গাড়ি কিনবেই। পরিবারে যাতে একটি গাড়ি রাখে এই বিষয় নিয়ে আমাদের আলাপ করা দরকার। ঢাকায় ভালো মানের গণপরিবহন চালু ও নাম্বারিস্ট করা, পরিবার প্রতি একটা- এগুলো নির্ধারণ করতে হবে। শুধু ভ্যাট ট্যাক্স বাড়িয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ভালোমানের গণপরিবহন চালু করতে হবে।’

আরও পড়ুন

কোলাহলের শহরে এক টুকরো প্রশান্তি ধানমন্ডি লেক

কার হাট লিমিটেডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি ক্রেতাদের জন্য নিরাপদ ও স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি করতে। প্রতি হাটে এখানে যে গাড়িগুলো রাখা হয়, সেগুলোর কাগজপত্র, রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য বিষয় আগে থেকেই যাচাই করে নেওয়া হয়। ফলে ক্রেতারা প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াই গাড়ি কিনতে পারেন। আমাদের লক্ষ্য হলো, ব্যবহৃত গাড়ি কেনাবেচার ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা ধরে রাখা।’

এম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর