রোববার, ৬ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

ঢাকাতেই টাকার ছড়াছড়ি!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৬ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা। এটি দেশের রাজধানী ছাড়াও সিংহভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে দেশের প্রধান শিল্পপ্রতিষ্ঠান, করপোরেট হেডকোয়ার্টার্স, আন্তর্জাতিক সংস্থার শাখা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার শক্তিশালী অবকাঠামো, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অব্যাহত ব্যবসায়িক সুযোগের ফলে দেশের প্রায় সব ব্যাংক তাদের মূল বিনিয়োগ ঢাকার দিকে প্রবাহিত করছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঢাকাকে নিজেদের বিনিয়োগের মূল ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে ঢাকাতেই টাকার ছড়াছড়ি।

সারাদেশের বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে ব্যাংগুলোর আমানত ও বিনিয়োগ বা ঋণ বিতরণের পরিসংখ্যাণ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব শেষ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। যা তার আগের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ছিল ১৮ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৮ কোটি। তিন মাসে আমানত বেড়েছে ১৮ হাজার কোটিরও বেশি। বিপরীতে গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। যেখানে গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো ঋণ বিতরণে গুরুত্ব পেয়েছে শহরাঞ্চলে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ঋণ বিতরণে অনীহা থেকেই গেছে। ঢাকা বিভাগে মোট আমানতের পরিমাণ ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৬১ শতাংশ।


বিজ্ঞাপন


তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর সব থেকে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে ঢাকা বিভাগে। আর সব থেকে কম বিতরণ হয়েছে সিলেট বিভাগে। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডিসেম্বর শেষে ঢাকা বিভাকে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৫২ হাজার ১৯০ কোটি। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৬৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ঢাকার পর পরই আমানত ও ঋণ বিতরণে অবস্থান করছে দেশের বণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম। গত একই সময়ে চট্টগ্রাম বিভাগে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ২ শতাংশ।

অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থা একেবারেই আলাদা। দেশের দক্ষিণ, উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলের শহর বা গ্রামগুলোর মধ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রমের অভাব স্পষ্ট। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে গিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ঋণের অভাবে বিপাকে পড়ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির গতিশীলতা এবং অন্যান্য শহরের উন্নয়ন অনেকটাই থমকে গেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য যে বিনিয়োগ সুযোগ পাওয়া উচিত, তা তাদের একেবারেই মিলছে না। যেখানে ঢাকাতে বড় বড় ঋণ সুবিধা এবং বিনিয়োগের প্রাধান্য রয়েছে, সেখানে এই শহরগুলোর উদ্যোক্তাদের জন্য তা প্রায় অবাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে দেশের বৃহত্তর অংশে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও তীব্র হচ্ছে।

তথ্য বলছে, ঋণ বিতরণে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। সেখানে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৬৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। পরেই রয়েছে খুলনা বিভাগ। যেখানে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৬৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এছাড়াও, রংপুর বিভাগে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৩৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, ময়মনসিংহ বিভাগে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ২১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা, বরিশাল বিভাগে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা ও সিলেট বিভাগে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।

এর আগে ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ঢাকা বিভাগে ঋণ বিতরণ ছিল ১১ লাখ ৩১ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এসময় চট্টগ্রাম বিভাগে ঋণ বিতরণ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা, খুলনা বিভাগে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, রাজশাহী বিভাগে ৬৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা, সিলেট বিভাগে ১৮ হাজার ১০২ কোটি টাকা, বরিশাল বিভাগে ১৮ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, ময়মনসিংহ বিভাগে ২১ হাজার ৪ কোটি টাকা ও রংপুর বিভাগে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।


বিজ্ঞাপন


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ঢাকার দিকে ঝুঁকিয়ে রাখা বিনিয়োগের কারণে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না এবং সেখানকার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে শিকড় গেড়ে বসে আছেন। ঢাকার বাইরে থাকা মানুষদের জন্য কম আয়ের কাজগুলোর পাশাপাশি বড় বিনিয়োগের সুযোগ বা ঋণ সুবিধা কিছুই নেই। যদি ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম ঢাকার বাইরে বিস্তৃত করতে না পারে, তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আর্থিক অস্থিতিশীলতা বাড়তেই থাকবে। তবে, এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কাছে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ঢাকার বাইরে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় গ্রাহকের সংখ্যা। ঢাকার তুলনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন তেমন একটি হয়নি, যা ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি এই অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে ব্যাংকগুলো সেখানেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের জিডিপির বড় অংশই ঢাকাতে হয়ে থাকে। আর এর একটা বড় একটা অংশ চট্টগ্রামে হয়। একারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এই দুই বিভাগে বেশি। যার ফলে এই অঞ্চলকেন্দ্রিক ডিপোজিট ও ঋণ বা বিনিয়োগ বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ভৌগলিকভাবে যাতে সারাদেশের উন্নয়ন যাতে সুশম হয়, দেশের প্রান্তিক পর্যায়েও যাতে উদ্যোক্তা তৈরি হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যাতে উদ্যেক্তা তৈরি হয় ব্যাংকগুলোকে সেদিকে বিনিয়োগে নজর দিতে হবে। ঢাকা চট্টগ্রামের সাথে অন্যান্য বিভাগের একটা পার্থক্য থাকবে। তবে এত বড় পার্থক্যটা প্রত্যাশা না। ঋণের বিষয়গুলো যাতে আরও গণতন্ত্রায়ন হতে হবে। এজন্য দেশের প্রন্তিক অঞ্চলগুলোতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ঋণ বিতরণ প্রবাহ আরও জোরদার করতে হবে।

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন