‘আমি একজন রূপান্তরিত নারী। ছোটবেলা থেকেই সমাজের মানুষের কাছে থেকে অপমানিত হয়েছি। তবু আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখিনি। লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। আমার আগ্রহ দেখে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন রাজবাড়ী জেলা শাখার নতুন কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছেন। এর মাধ্যমে রূপান্তরিত নারীদের অগ্রযাত্রায় আরও একধাপ এগিয়ে গেল।
আমি ভবিষ্যতে সামজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সুবিধাবঞ্চিত ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সামাজিকভাবে কাজ করতে চাই। সমাজের আর অন্য দশজন নারী-পুরুষের মতই সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে দেখিয়ে দিতে চাই আমারাও পারি’। কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ী জেলার একজন রূপান্তরিত নারী শিশির বিন্দু (২৮)।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (১১ জানুয়ারি) ছাত্র ইউনিয়নের রাজবাড়ী জেলা সংসদের দ্বাদশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন শিশির বিন্দু।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্রথম একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছাত্রনেতা নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদ শিশিরকে অভিন্দনন জানিয়েছে।
শিশির বিন্দু রাজবাড়ী জেলা সদরের মিজানপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সোনাকান্দ গ্রামের মো. হান্নান শেখ ও মোছা. মিনি বেগমের বড় সন্তান। জন্মগতভাবে শিশির বিন্দু একজন ছেলে হিসেবে জন্মনিলেও পরিবর্তিতে তিনি নারীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।
শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে শিশির বিন্দু ঢাকা মেইলকে বলেন, ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে তার জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েলি স্বভাবের ছিলো সে। স্থানীয় একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাশের পর জেলা সদরের আল্লা নেওয়াজ খাইরুল একাডেমি থেকে বাণিজ্য বিভাগে ২০১০ সালে এসএসসি পাশ করেন।
বিজ্ঞাপন
তারপর রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচ এসসি পাশ করে একই কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে ডিগ্রী পাশ করার পরে ফরিদপুর ঐতিহ্যবাহী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে সে মাস্টার্সের শেষ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী।
শিশির বিন্দু বলেন, ছোট বেলায় আমার পারিবারিক নাম ছিল জীবন রহমান। আমি পরিবারের বড় সন্তান। আমার বাবা মা অনেক দরিদ্র। তবু তারা আমাদের ৩ ভাই বোনের জন্য অনেক কষ্ট করে খাবার জোগাড় করেছেন।
আমি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতাম তখন থেকেই মেয়েদের পোশাক পড়তে আর সাজগোজ করতে অনেক ভালো লাগতো। পরে আমি যখন কলেজে ভর্তি হই তখন আমার মতো যারা এমন মানুষ। তাদের কমিউনিটির সাথে আমার পরিচয় ঘটে। আমি নিজের মধ্যে নারীসত্তাকে আবিষ্কার করি। পরবির্ততে আমি আমার পরিবারের কাছে এসব জানালে তারা আমাকে ছেলের মতই থাকতে বলে। কিন্তু আমি তো জানি যে আমি শরীরে ছেলে হলেও মনের দিক থেকে একজন নারী।
পরবর্তিতে আমি ২০১৩ সালে ভারতে গিয়ে নারীতে রূপান্তর হই। এখন আমি একজন সম্পূর্ণ রূপে নারী।
আমি গত ২০২২ সালের শুরুর দিকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের সাথে পরিচিত হই। তাদের ইউনিয়নের সকল কার্যক্রম ও গঠনতন্ত্র পড়ে আমি ছাত্র ইউনিয়নের একজন সদস্য হই। এখন তারা বর্তমান কমিটিতে আমাকে সহ সভাপতি পদে নির্বাচিত করেছেন। আমি অনেক খুশি যে তারা আমার মতো সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে মূল্যায়ন করেছেন। আমি লেখাপড়া শেষ করে অসহায় নিপীড়িত মানুষ ও আমার মতো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে সামাজিকভাবে কাজ করতে চাই। এজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে ভালো একটা কাজের সুযোগ চাই।
শিশির বিন্দু আরও বলেন, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে সত্যিকার অর্থেই কাজ করে ছাত্র ইউনিয়ন। সেখানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কাওসার আহমেদ রিপন। তার অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে আসা। আমি ছাত্র রাজনীতিতে এসেছি কয়েক বছর আগে। গত কমিটিতে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম। এবার সহ সভাপতি হয়েছি। আমি ছাত্র রাজনীতি করব। এই পর্যায় শেষ করে মূল দলে কাজ করব।
ছাত্র ইউনিয়নের নব নির্বাচিত সভাপতি কাওসার আহমেদ রিপন বলেন, শিশির বিন্দু অধিকার আদায়ে কাজ করা একজন মানুষ। সে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনে বুঝে আমাদের সাথে কাজ করে। গত বছর কোআপট সদস্য হিসাবে তাকে কমিটিতে অন্তভুক্ত করা হয়। এরপর এবারের সম্মেলনে তাকে সহ সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের প্রথম কনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছাত্র রাজনীতিতে এসেছে। আমরা রাজবাড়ী জেলা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত জানাই।
ছাত্র ইউনিয়নের নব নির্বাচিত কমিটির শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অর্ণিকা দাস বলেন, একজন রূপান্তরীত নারী শিশির বিন্দুকে ছাত্র রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমি একজন নারী হয়ে শিশিরের জন্য অনেক গর্ববোধ করি। সমাজে অনান্য নারী পুরুষের মতো তারাও সকল কাজে এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা রাখছি।
রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও গোয়ালন্দ সরকারি কামরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু মুসা বিশ্বাস বলেন, একজন রূপান্তরীত নারীকে সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার। এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সমাজের বিত্তবানদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। তাদেরকে নানাবিধ কাজে নিয়েজিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে এরাও অনেক কাজে ভূমিকা রাখবে।
প্রতিনিধি/এসএস