চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া কনসালটেন্টের দু’টি পদ শূন্য থাকায় গত এক মাস ধরে হাসপাতালের অপারেশন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বাইরে থেকে ডাক্তার এনে সীমিত পরিসরে কিছু অপারেশন করা হলেও জরুরি অপারেশন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বাইর থেকে চিকিৎসক আনতে হলে রোগীদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়, যা জরুরি রোগীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে সাধারণ রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বাইরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অধিক অর্থ ব্যয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন, আবার কেউ টাকার অভাবে অপারেশন ছাড়াই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
১৯৭০ সালে ৫০ শয্যার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ২০০৩ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয় এবং বর্তমানে এটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল না থাকায় হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলছে। বিশেষ করে, হাসপাতালের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদ সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। সর্বশেষ জুনির কনসালটেন্ট ডা. নুরুন্নাহার খানম নদী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোরে বদলি হওয়ার পর থেকে হাসপাতালের স্বাভাবিক অপারেশন কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
অ্যানেসথেসিয়া কনসালটেন্ট অপারেশনকে রোগীদের সাধারণ (জেনারেল), স্পাইনাল এবং লোকাল অ্যানেসথেসিয়া প্রদান করে থাকেন। বর্তমানে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র থেকে চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক এনে খুব সীমিত পরিসরে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে ছোটখাটো অপারেশন চালানো হচ্ছে। তবে বড় ও জরুরি অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি হাসপাতালে জরুরি অপারেশন না হওয়ায় সাধারণ রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর শরণাপন্ন হচ্ছে। এতে রোগীরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি স্থানীয় ক্লিনিকগুলোর ব্যবসা বেড়ে গেছে। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে পরিকল্পিতভাবে সদর হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শুধু অ্যানেসথেসিয়া বিভাগেই নয়, আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সিনিয়র চক্ষু কনসালটেন্ট, সিনিয়র পেডিয়াট্রিক কনসালটেন্ট, সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট, জুনিয়র ইএনটি কনসালটেন্ট, রেডিওলোজিস্ট, মেডিকেল অফিসার এবং ডেন্টাল সার্জনের পদ। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ২৮টি পদও শূন্য। সুইপারের সাতটি পদের মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে খালি থাকায় হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে।
প্রতিদিন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় ১২০০ জন, আন্তঃবিভাগে ৩০০ জন এবং জরুরি বিভাগে ২০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও লোকবল না থাকায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।
রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, জরুরি অপারেশন না হওয়ায় এবং দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে অনেকেই চিকিৎসা না নিয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। সদর হাসপাতালের ওপর পুরো জেলার মানুষ নির্ভরশীল হলেও তারা এখন চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে এটাকে পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন, যাতে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো লাভবান হয়।
চুয়াডাঙ্গা শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান বলেন, সদর হাসপাতালের একমাত্র অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তারকে হঠাৎ বদলি করে দেওয়া হয়েছে, আর এখন পদটিই শূন্য। এতে সাধারণ রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাতে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর ব্যবসা বাড়ে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে এখন সবাই বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের দ্বারস্থ হচ্ছে, যেখানে খরচ অনেক বেশি। গরিব মানুষ কীভাবে চিকিৎসা নেবে?।
চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা এলাকার রহিমা খাতুন (রোগীর মা) বলেন, আমার মেয়ের জরুরি অপারেশন দরকার ছিল। এখানে ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না, বাইরে থেকে এনে অপারেশন করা হচ্ছে। কিন্তু এতে প্রচুর দেরি হচ্ছে। জরুরি অপারেশন হচ্ছে না, আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি। সরকারি হাসপাতালে যদি সবসময় অপারেশন করা যেত, তাহলে এত কষ্ট হতো না।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার (অ্যানেসথেসিয়া) রাকিবুল ইসলাম বলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে গত এক মাস ধরে অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ না থাকায় আমি এখানে সহায়তা দিচ্ছি। তবে এটি আমার নিয়মিত দায়িত্বের বাইরে হওয়ায় প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি, সীমিত জনবল ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে শুধু কিছু নির্দিষ্ট অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু জরুরি অনেক অপারেশনই করা যাচ্ছে না। এতে রোগীদের যেমন ভোগান্তি বাড়ছে, তেমনি চিকিৎসা ব্যবস্থাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
সুপার স্পেশালাইজডের নিয়োগ বাতিলের প্রতিবাদ, পুনঃতদন্তের দাবি
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলার মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসার জায়গা হলো সদর হাসপাতাল। এখানে বহুদিন ধরেই নানামুখী সমস্যা ও সংকট বিরাজ করছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জনবল সংকট। এই হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও, জনবল এখনো ৫০ শয্যার হিসেবেই রয়ে গেছে। ফলে রোগীদের সেবা দিতে আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে, একমাত্র অ্যানেসথেসিয়া কনসালটেন্টের বদলির পর জরুরি অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আমরা স্থানীয়ভাবে ডাক্তার ম্যানেজ করে খুব সীমিত পরিসরে জরুরি কিছু অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছি। সমস্যাগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং আমরা দ্রুত সমাধান আশা করছি।
প্রতিনিধি/এসএস