সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

ফলাফল নিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক-শিক্ষকদের ‘দায়সারা’ ভাব

চৌধুরী মাছাবিহ্, কুবি
প্রকাশিত: ০১ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৭ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ নম্বর ইনকোর্স এবং ৬০ শতাংশ নম্বর সেমিস্টার চূড়ান্ত পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের শর্তাবলি অনুসারে ইনকোর্সের ফলাফল চূড়ান্ত পরীক্ষার ১৪ দিন আগে দিতে হবে। তবে বিভাগগুলোতে এই নিয়ম মানা হয় না। অধিকাংশ কোর্সে সেমিস্টার শেষ হওয়ার কয়েকমাস পরেও ইনকোর্সের রেজাল্ট পান না শিক্ষার্থীরা। কিছু কোর্সে এই ফলাফল চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে দিলেও তা নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষার যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, শিক্ষক ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়সারা ভাবের কারণে এমনটি হয়।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ৪০ শতাংশ নম্বর সেমিস্টার চলাকালীন ক্রমাগত মূল্যায়ন করেন শিক্ষকরা। এই নম্বর ইনকোর্স হিসেবে পরিচিত। মিডটার্ম, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ও উপস্থিতির হারের ওপর ইনকোর্স মূল্যায়ন করা হয়।


বিজ্ঞাপন


কার্যালয়ের শর্তাবলিতে আছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে প্রস্তুতির জন্য নূন্যতম ১৪ দিন বন্ধ দিতে হবে। বন্ধের আগে ইনকোর্সের ফলাফল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে সংযুক্ত করতে হবে এবং বিভাগের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দিতে হবে। তবে বিভাগগুলো এই শর্ত মানছে না। প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। 

বিভাগগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কয়েকজন শিক্ষক ইনকোর্সের রেজাল্ট সেমিস্টার চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে দেন না। অন্য শিক্ষকরা ফলাফল প্রকাশ করলেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের বেধে দেওয়া সময়ে প্রকাশ করেন না। পরীক্ষার দিন সকালে অথবা পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে কোর্সের মেসেঞ্জারে ফল জানিয়ে দেন তারা। ফলাফল নিয়ে এমন বিড়ম্ববনার জন্য শিক্ষকদের উদাসীনতা ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা।

কলা ও মানবিক অনুষদের দুটি বিভাগে মধ্যে ইংরেজি বিভাগের শোচনীয় অবস্থা। ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ৫ম সেমিস্টার শেষ হওয়ার তিন মাস হতে চললেও ৫টি কোর্সের মধ্যে ৪টি কোর্সের ইনকোর্সের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়াও ১৬ ব্যাচের ৩য় সেমিস্টারের ৫টির মধ্যে ৩টি কোর্স এবং ১৭ ব্যাচের ২য় সেমিস্টারের ৫টি কোর্সের মধ্যে একটিরও ফলাফল দেওয়া হয়নি। 

এই বিষয়ে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শরিফুল করিম, ‘আমাদের ভুল ছিল’ দাবি করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি আরও জানান, ‘আগামীতে সেমিস্টার পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইনকোর্সের রেজাল্টসহ রুটিন দপ্তরে পাঠানো হবে।’


বিজ্ঞাপন


বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চূড়ান্ত পরীক্ষার এক থেকে দুই দিন আগে তাদের ইনকোর্স রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ৩য় সেমিস্টার শেষ হওয়ার চার মাস পার হলেও এই প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত ৪টি কোর্সের মধ্যে ৩টির ইনকোর্সের রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়নি। তিনটি কোর্সের মধ্যে একটি কোর্স নিয়েছেন ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী এম আনিছুল ইসলাম। অন্য দুইটি কোর্সও অতিথি শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি সমন্বয় করে নিয়েছেন।

ফলাফল প্রকাশ না হওয়ার বিষয়ে কাজী এম আনিছুল ইসলাম বলেন, এটা আমাদের ভুল আমি স্বীকার করছি। এতদিন বিভাগে শিক্ষক সংকট থাকায় আমাদের ওপর অনেক চাপ ছিলো। তবে বর্তমানে রানিং কোর্সগুলোর ইনকোর্সের রেজাল্ট সেমিস্টার ফাইনালের আগে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

বিভাগের অন্য ব্যাচগুলোরও ইনকোর্স রেজাল্ট ছাড়া চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া হয়। অর্থনীতি বিভাগের ১৭ ব্যাচের ২য় সেমিস্টার শেষ হওয়ার দুই মাস পার হলেও ৫টি কোর্সের মধ্যে ৩টির ইনকোর্সের ফলাফল দেওয়া হয়নি। এছাড়াও ১৫ ও ১৬ ব্যাচে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।

এই অনুষদের বাকি তিন বিভাগে চূড়ান্ত পরীক্ষার দুদিন আগে আবার কখনও পরীক্ষার দিন সকালে ইনকোর্স রেজাল্ট প্রকাশ করে দায় এড়ানোর অভিযোগ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। 

ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ১৩ ব্যাচের স্নাতকোত্তর ১ম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়। এই সেমিস্টারের ৫টি কোর্সের মধ্য ২টির ইনকোর্স রেজাল্ট পরীক্ষা চলাকালীন প্রকাশ করা হয়। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অন্য তিন বিভাগেও কয়েকটি ব্যাচে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোর চিত্রও ভিন্ন নয়। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১৫ ব্যাচের ৫ম সেমিস্টার শেষ হয় গত ৭ জানুয়ারি। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই সেমিস্টারের ৫টি কোর্সের মধ্যে ২টির ইনকোর্সের ফল প্রকাশ করা হয়নি। ফার্মেসি বিভাগের ১৭ ব্যাচের ২য় সেমিস্টার শেষ হওয়ার দুই মাস পার হলেও ৭টি কোর্সের একটিরও ইনকোর্সের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।

গণিত, রসায়ন ও পরিসংখ্যান বিভাগের ইনকোর্স রেজাল্ট চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে প্রকাশ করলেও কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ১৪ দিন আগে প্রকাশ করা হয় না বলে জানা গেছে।

আইন বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ৩য় সেমিস্টার চলমান হলেও ১ম সেমিস্টারের ১টি ও ২য় সেমিস্টারের ৩টি কোর্সের ইনকোর্সের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।

প্রকৌশল অনুষদের দুটি বিভাগে এই রেজাল্ট নিয়ে কয়েকজন শিক্ষক গড়িমসি করেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা।   

সময়মত পরীক্ষার ফল না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোর্স শিক্ষকের হেলাফেলার কারণে আমরা ইনকোর্স রেজাল্ট পাই না। যদি স্যাররা রুটিন মাফিক ক্লাস, পরীক্ষা নিতেন তাহলে আমরা নির্ধারিত সময়ে রেজাল্ট পেতাম। এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের গাফিলতির কারণে ইনকোর্সের রেজাল্ট ছাড়া আমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়।

ইনকোর্সের ফলাফল প্রকাশ না করে চূড়ান্ত পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও কুবিতে প্রতিনিয়ত এমনটি ঘটছে। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নুরুল করিম চৌধুরী বলেন, আসলে ওইভাবে ইনকোর্সের রেজাল্ট দেখা হয় না। বিভাগ থেকে শিক্ষকদের মৌখিক আশ্বাসে আমরা রুটিন ইস্যু করে দেই। তবে আমরা কিছুদিন আগে সকল বিভাগে চিঠি দিয়েছি যেন রুটিনের সঙ্গে ইনকোর্সের ফল পাঠানো হয়।

চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে ইনকোর্স ফল পাওয়ার সুবিধা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিজাম উদ্দিন বলেন, সঠিক সময়ে ফল দিলে পড়ার প্রতি আগ্রহ আরও বাড়ে। ফল না দেওয়ায় বুঝতে পারি না কোন কোর্সে কতটুকু এফোর্ট দিতে হবে।

এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল বলেন, ইনকোর্সের ফল যেন ১৪ দিন আগে দেওয়া হয়— এটা নিয়ে নতুন করে আমরা কাজ করছি। আগামী সপ্তাহে আমরা রিপোর্টটা বিভাগে পাঠিয়ে দিবো এবং বিষয়টি নিয়ে বাধ্য বাধকতা চালু করবো।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন