প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মানুষ যুগের পর যুগ যাতায়াতে দুর্ভোগের শিকার হলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি আজও। দেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন বহু কষ্টে নদী পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে। বর্ষায় সে কষ্ট চরম পর্যায়ে পৌঁছে। সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে ইতোপূর্বে একাধিক সমীক্ষা চালানো হলেও কার্যত তার কোনো ফল পায়নি দ্বীপবাসী। স্থানীয়রা অতীত সিন্ডিকেট দুষ্টচক্রকে দুষলেও বর্তমান সরকারের কাছে নদীবন্দর পেতে জোর দাবি তুলছেন।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ২১শ' বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রায় ৩০০ বছর আগে জনবসতি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় ৭ লাখের বেশি মানুষ এখানে বসবাস করছে। মূল ভূ-খণ্ডে পৌঁছতে যোগাযোগের প্রধান এবং একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে ভাঙতে ভাঙতে নৌপথের দূরত্ব বেড়েছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। প্রতিনিয়ত যেখানে ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। জরুরি কাজে কিংবা কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোট কিংবা ট্রলারেই তাদের একমাত্র ভরসা। বর্ষাকালে নদী অধিক উত্তাল থাকলেও এই দ্বীপের জনগণের নদী পারাপারে নেই বিকল্প কোনো ব্যবস্থা। ফেরি চলাচলের অনুমোদন হবে হবে বলে আজও তা অধরা। যারাই যখন ক্ষমতায় আসে তারাই তখন বাসিন্দাদের আশার বাণী শুনিয়ে সিন্ডিকেট সুবিধা নিয়ে সময় পার করার অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার লাখ মানুষের উপকূলীয় সন্দ্বীপকে ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নদীবন্দর ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পরেরদিন ওই প্রজ্ঞাপনকে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। যার ফলে সেখানকার উভয় প্রান্তে ফেরি নির্মাণ, ড্রেজিং, জেটি ও টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এখন শেষের দিকে। চলতি বছরের মার্চ থেকে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ সমুদ্র যাত্রায় ফেরি চলাচল শুরু হওয়ারও কথা রয়েছে। অথচ বিপুল সংখ্যক মানুষ আর বিশাল এ হাতিয়া উপকূলে নদীবন্দর না পেয়ে হতাশ এ দ্বীপবাসী।
‘সচেতন নাগরিক সমাজ-হাতিয়া’ নামক সামাজিক সংগঠনের সদস্য আমিরুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির যুগে উপকূলীয় এ এলাকায় নদীবন্দর না পাওয়া আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার সদিচ্ছা দেখালে আমরা দ্রুত নদীবন্দর পাব এবং তার পথ ধরে ফেরিসহ নৌপথের সব যোগাযোগ আমাদের জন্য সহজতর হবে। তিনি আরও বলেন, নদীবন্দর পেলে সহজতর যোগাযোগের ফলে প্রতিদিন সকালে নোয়াখালী জেলা সদরে গিয়ে জরুরি কাজ সেরে বিকেলে আবার নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারব। বর্ষা কিংবা দুর্যোগের সময়ও আমরা ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে হবে না।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, নদী ভাঙন রোধে ব্লকের দাবিতে এ পর্যন্ত মানববন্ধন, লেখালেখিও কম হয়নি। তবুও কর্তা মহলের নজর পড়েনি এ দ্বীপের দিকে। দীর্ঘ সময় ধরে একটা জনপদের নদী ভাঙনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় অবিরাম ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ৫০ মাইল এলাকা। মেঘনার করাল গ্রাস ধ্বংস হয়েছে লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি। যেখানে গৃহহীন হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।
অবশেষে ধৈর্য হারা হয়ে দ্বীপের মানুষ নিজেদের অর্থ, শ্রম-ঘামে স্ব-উদ্যোগে নলচিরা ঘাট এলাকায় জিও ব্যাগ দ্বারা অস্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ কার্যক্রম শুরু করে। ‘হাতিয়া নদী তীর সংরক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন’ কর্তৃক ২০১৯-২০২০ সাল থেকে প্রায় এক কিলোমিটারের কাজ বাস্তবায়ন করে। যেখানে বাপাউবোর বাস্তবায়নকৃত কাজও রয়েছে। খরস্রোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নকৃত কাজের বিনষ্ট হওয়া অংশও প্রায়ই মেরামত করতে হয়েছে জানান উক্ত তীর সংরক্ষণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক সদস্য।
নোয়াখালী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জামিল আহমেদ পাটোয়ারী জানান, নলচিরা ঘাট এলাকায় ইতোপূর্বে তারা অস্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ বাস্তবায়নের কিছু কাজ করেছে। নদী ভাঙন রোধে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এবং পরিবেশ ও ভৌগোলিক তথ্য পরিষেবা কেন্দ্র (সিইজিআইএস) কর্তৃক যৌথ সমীক্ষা কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে হাতিয়ার নলচিরা, সোনাদিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহের জন্য ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) দাখিল করা হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া, চলতি মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখে হাতিয়ার নদী ভাঙনরোধে গণশুনানি হয় এখানকার ৭টি পয়েন্টে।
উপকূলীয় এলাকা দ্বীপ হাতিয়ায় নদীবন্দর পাওয়ার বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (প্রশাসন) কাজী ওয়াকিল নওয়াজের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, এ দ্বীপ বহু প্রাচীন এক জনপদ। এ দ্বীপবাসীর কষ্ট সম্বন্ধে আমি অবগত আছি। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্টে এটাকে কীভাবে যুক্ত করা যায় আমরা সে বিষয়ে ভূমিকা রাখব।
প্রতিনিধি/এসএস